বধুবরন

বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 19

“- ও বাবাই! বাবাই তুমি বলো না কেন? মাম্মী!
“- আরে আমার আম্মা! চুপ কর! শৌর্য ওঠ না বাবা!
“- না! আমার গেমস চাই!
“- আমার মোবাইল টা নিয়ে ভেঙে ফেলিস তাও চল বাবা!
“- না! না! আমার ঐ গেমস চাই।নুরভি ফেলে দিল কেন? নুরভি শয়তান!
“- তুই শয়তান! হাতির ফেস! চুপ কর।ও বাবাই বলো না বাবাই!
“- শুভা! আমি স্ট্রোক করবো কিন্তু
“- উফ! এতো শুভা শুভা করে গলা ফাটাচ্ছেন কেন? খুব তো বলেছিলেন আমার৪ টা বাচ্চা থাকবে।চারটাকে একসাথে নিয়ে ঘুরবো দুটোকে নিয়েই উনি স্ট্রোক করেন আবার ৪ টার গান শোনায়।
“- আর শোনাব না।এবার এদের থামাও।শৌর্য বাবা সোনা ওঠ! অসুস্থ হয়ে যাবি তো।
“- না! না আআ
“- শুভা আমার ছেলেটা বালুতে গড়াগড়ি করছে কেন?
“- নুরভি বাবাইয়ের কোল থেকে নেমে এদিক আয়! শৌর্য ওঠ।
“- ও মাম্মী!
“- চুপ! একদম চুপ!
মায়ের বড় বড় চোখের ধমকে শৌর্য নুরভি ভীতু বিড়াল ছানার মতো পাশাপাশি দাঁড়ায়। নীল হা করে তাকিয়ে তাকে।এতোক্ষনে মাথাটা হালকা লাগছে।আহ! কি শান্তি!
“- আপনিও উঠুন! আর এই বিড়ালের ছাও দুটো আমার আগে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকবি।ঢুকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকবি।যা! শুভার যা বলে হালকা ধমক শুনে শৌর্য নুরভি দৌড়ে পালায় বাথরুমে।নীল বসে হাত বাড়িয়ে দেয় শুভার দিকে।শুভা রেগে ভ্রুনাড়ায়,
“- উঠাও না বউ! আমার বিড়াল ছানার মাম্মী। উঠাও!
“- উরে ডং! দুই দুটোর বাচ্চার বাপ হয়ে গেলেন অথচ আপনার ভাব কমে না।ধরুন! উঠে আমাকে উদ্ধার করুন।
নীল শুভার হাত আচমকা টান দিতেই শুভা হুমড়ে নীলের বুকে উপর পড়ে।
“- কি শুরু করেছেন! ছাড়ুন! দেখে ফেলবে তো ধ্যাৎ!
“- এতো নড়াচড়া করো কেন? চুপ করে বুকে থাকো।দুটোর বাচ্চা বাবাই তো হলাম কিন্তু টেরই পেলাম না।ও বউ! আরেকটার প্লান করি না!
“- পাগলে খামচি মারছে? বাচ্চার শখ এখনও মেটে নাই ডাকবো শৌর্য নুরভিকে?
“- আরে ভয় দেখাও কেন? আমার বিড়াল ছানা দুটো লক্ষি শুধু একটু জেদি। ওটার জন্য তুমি তো আছোই।নীল শুভাকে কোলে তুলে বাড়ির পথে হাটা ধরলো।শুভা এতো বলেও নীলের কোল থেকে নামতে পারলো না।নীল সোজা বাথরুমে ঢুকলো।সেখানে শৌর্য নুরভি আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। বাবাইয়ের কোলে মাম্মীকে দেখে নুরভি খিলখিল করে হেসে উঠলো।শৌর্যের মন তখনও খারাপ গেমসের জন্য তাই ও হাসলো না।গোমড়ামুখে দাড়িয়ে রইল এককোনায়।
“- এ বাবাই মাম্মী কে কোলে নিছে।মান্মী বাবু হয়ে গেছে।কি মজা! কি মজা!
“- নীল নামান!
“- আরেকটু রাখি না কোলে। দেখো আমার মেয়েটাও খুশি হয়েছে।
“- বদের মেয়ে বদ ই হয়।নামান আপনি।
নীল নিরুপায় হয়ে নামিয়ে দিতেই নুরভি দৌড়ে এসে বাবাইকে জড়িয়ে ধরে।শুভা নীল মিলে ঝিলে পাশের কূয়া থেকে পানি টেনে বাচ্চা দুটোকে নিজ হাতে গোসল করায়।নীলের অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে সন্তানদের সাথে কাটানো এই মুহুর্তগুলোতে।শৌর্য নুরভির গা হাত পা মুছে শুভা নিয়ে গেল।ওদের কাপড় পড়িয়ে নিজেও ভেজা কাপড় পাল্টে ফেলতে এসে দেখে নীল নগ্ন গায়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ঠোঁটে সেই দুষ্টু হাসি।শুভা কাপড় টা পাশে ঝুলিয়ে চুলগুলো খোপা করতে করতে বললো,
“-আপনি ভেজা শরীরে দাড়িয়ে আছেন যে? তাড়াতাড়ি গোসল করে ঘরে যান।আমি পরে আসছি।বলে শুভা বাথরুম থেকে বের হতে পা বাড়াল।
নীল ঠাস করে দরজা লাগিয়ে শুভার কোমর টেনে ধরলো।
“- সখি! কেন এতো দূরত্ব তোমার! কেন করো অভিমান।আমার বুকের তৃষ্ণা মেটে না তোমার ছোঁয়া না পেলে।একটু তো সদয় হও।তোমার প্রেমের কাঙালের মনের দুঃখ একটু তো বোঝো।কাছে টানো সখি কাছে টানো।না সরাও দূরে আর না বাড়াও ব্যবধান। নীলের কথার জালে শুভা আটকে পড়ে।তনু মন বিবশ হয়ে যায় নীলের ভালোবাসার জালে।
নীল খাটে বসে শুভার চুল মুছে দিচ্ছে আর শৌর্য নুরভির সাথে খুনশুটি করছে।দিন রাত এভাবে কেটে যাচ্ছে ভালোবাসার মেলবন্ধনে।শুভা আজ স্বামী গৃহে ফিরবে।বধূবরণ হবে শুভার।সন্তান দুটোকে বুকে আঁকড়ে নীল শুভা সেন্টমার্টিনের নির্ভেজাল, নির্মল বায়ু,পরিচিত লোকদের বিদায় দিয়ে ছুটছে গন্তব্যে।টেকনাফের দমদমিয়া ফেরি ঘাটের উদ্দেশ্যে জাহাজে তে চড়লো চারজন।বঙ্গোপসাগরে সাগরের উত্তাল নীল জল উছলে এগিয়ে চলছে জাহাজ।নুরভি শৌর্য অবাক নয়নে এ সৌন্দর্য অবলোকন করছে।শুভা নীলও ওদের সাথে যোগ দিল।বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপের মনোরম সৌন্দর্যের কোলে বড় হলেও এই সমুদ্রের জলের খেলা আজ অন্যরকম আনন্দ দিচ্ছে শৌর্য নুরভিকে।প্রবাল দ্বীপের বালুচরের ছাগলমুড়ি গাছ কিংবা কেয়াগাছের পাতার সাথে তো বহু খেলেছে। কিন্তু ঢেউয়ের সাথে খেলা হয়নি ওদের। আরব সাগর ও ভারত সাগরের অভিন্ন জলের ধারার সেন্টমার্টিনের ঢেউয়ে মা যে তাদের কোনোদিন খেলতে দেয় নি।শুধু দু একবার মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে পা ভিজিয়ে এসেছিল।জাহাজ বঙ্গোপসাগর থেকে নাফ নদীতে চলতে লাগলো। চলার পথের উছলে পড়া জল দেখে শৌর্য, নুরভি খিলখিল হাসে।নীল নুরভি শৌর্যের কপালে চুম্বন দিয়ে প্রশান্তির হাসি হেসে বলে,
“-নুরভি, শৌর্য! তোমরা কি জানো এতোদিন তোমরা কোথায় ছিলে?নুরভি শৌর্য দুজনেই বলে উঠলো,
“- হ্যাঁ! উত্তর পাড়া! সেন্থমার্তিন। মাম্মী আমাদের শিখিয়েছে তো।
“- তাই! আমার বাচ্চাগুলো তো খুব ইন্টিলিজেন্ট।নীলের কথা শেষ না হতেই একদল বালিহাঁস পাল্লা দিয়ে ছুটলো ফেরির সাথে।তা দেখে নুরভি শৌর্যের সে কি আনন্দ! নুরভি তো জেদ করে বসলো তার ঐ পাখি চাই ই চাই।শৌর্য মায়ের কোলে সে সাহস পেলো না।মাকে ওর বড্ড ভয়।সে কোনো সময় ঠাস করে লাগিয়ে দিতে পারে।নুরভির মতো মাথা মোটা মেয়ে ওর জমজ কি করে হয় শৌর্য ভেবে পায় না।নুরভির ভ্যা ভ্যা গলা ছেড়ে কান্না শুনে কানে হাত দিয়ে বসে আছে শৌর্য।জাহাজের সবাই নুরভির কান্না দেখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।তারউপর মুখের যে ভাষা!
“- বাবাই! আমি পাখি নেবো।ও বাবাই দাও না!
“- মা! ও পাখি আমি কি করে ধরবো বলো?
“- লাফ দিয়ে ধরবা! ধরো যাও যাও।
“- আমি কি বিড়াল না বাঘ যে লাফ দিয়ে ধরবো?
“- ও বাবাই তুমি কিছুই পারো না।পঁচা ডিম বাবাই!মাম্মী আমার একটা পাখি ধরা বাবাই এনে দাও।
ফেরির সবাই তাকিয়ে আছে দেখে শুভা নুরভিকে ধমক দিল কিন্তু নুরভি এবার থামলো না উল্টো দ্বিগুন বেগে আওয়াজ তুললো।নুরভি এই সাহসেই জোর বাড়িয়েছে কারন মা এতো লোকের সামনে আর যা করুক ওকে মারবে না।রাগে,লজ্জায় শুভার মুখটা লাল হয়ে আছে। নীল শুভার অসহায় মুখটা দেখে মুচকি হেসে নুরভিকে বললো,
“- আচ্ছা পাখি নিবে তাই তো?
“- হ্যাঁ!
“- তাহলে আগে গল্প শোনো।
“- না গল্প শুনবো না।পাখি নেবো।দাও এনে দাও।
“- আরে শোন ই না রে মা।তারপরও যদি তোর পাখি লাগে আমি এনে দেব।
“- সত্যি তো?
“- একশ এক বার সত্যি। শুভার দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে বলে।শুভা চোখ বড় করে এদিক ওদিক তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নামিয়ে বসে থাকে।তা দেখে নীলের খুব হাসি পায়।
“- আচ্ছা শোনাও! তবে মজার গল্প শোনাবা।
“- ওকে আমার মা! তাহলে শোনো! অনেক অনেক বছর আগের কথা! সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে আরব দেশ ছিল।সে দেশের একদল বনিক! বনিক বোঝো মা! নুরভি না সূচক মাথা নাড়ায়।শৌর্য বাবা! তুমি বোঝো?
“- না বাবাই!
“- বনিক হলো যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে।কেচা বেচা করে বিভিন্ন জিনিস।যেমন কাপড়,মসলা,সোনা আরও অনেক কিছু। তারা এসব করতো জাহাজে চড়ে বিভিন্ন দেশে দেশে। তো সেই বনিক রা একবার জাহাজে করে বানিজ্য করতে যাচ্ছিল।পথিমধ্যে তারা এমন একটা জায়গায় আসলো যেটা কি না তারা আগে কখনও দেখে নি।নতুন একটা জায়গা।শৌর্য নুরভির আগ্রহের মাত্রা বেড়ে গেল।মনোযোগ দিয়ে বাবাইয়ের গল্প শুনতে লাগলো দুজন।শুভাও শুনছে মুচকি হেসে নীলের দিকে তাকিয়ে।
শুভার চোখে চোখ পড়তেই নীল মুচকি হেসে থেমে গেল।বাবাইকে থামতে দেখে শৌর্য বলে উঠলো,
“- তারপর বাবাই! বলো
“- তারপর! তারা দেখলো নীল সাগরের জলের পাশে একটা জায়গা।চারিদিকে অসংখ্য নারিকেল গাছের সারি।বনিকেরা সাবধানে নিচে নামল।ঘুরে ঘুরে পুরো জায়গাটা দেখলো।না! বিপদের কিছুই নেই।বরং খুবই সুন্দর একটা জায়গা।বালুচরের তীর ভেজানো নীল জল ছোট ছোট পাথরের মতো প্রবালে বেছানো বালুকাবেলা।নীল জলের তলে বিভিন্ন মাছ।তাদের খুবই পছন্দ হলো জায়গাটা।তাই তারা ঠিক করলো এবার থেকে এই পথে বানিজ্য করতে গেলে এখানেই বিশ্রাম নেবে।অপেক্ষা করবে।এজন্য তারা এই জায়গার একটা নাম দিল।তোমরা শুনবে সে নাম? নুরভি উদগ্রীব হয়ে বললো,
“- হ্যাঁ বাবাই শুনবো।
“- জাজিরা! যেহেতু তারা অন্য দেশের অন্য ভাষার লোক তাই তাদের ভাষায় অপেক্ষা করার জায়গাকে বলে জাজিরা।
“- জাজিরা! বাবাই নামটা সুন্দর। তাই না নুরভি।শুভা এতোক্ষনে বুঝতে পারলো নীলের গল্পের জাজিরা কোন জায়গা।শুভারও এবার কৌতুহল বেড়ে গেল।জাহাজের অনেক যাত্রীই মনোযোগ দিয়ে শুনছে নীলের কথা।নীল আবার বলা শুরু করলো।
“- এরপর জাজিরা থেকে নাম হলো জাঞ্জিরা এজন্য পরে যারা বসবাস করে তারা সেই জায়গাকে বলে নারিকেল জিঞ্জিরা। নারিকেল গাছের ছায়ানিবিড় পরিবেশের অপরুপ সৌন্দর্যে ঘেরা তো তাই।এরপর একসময় আবার ডুবে গেল এই জাজিরা।সাগরের নিচে চলে গেল।তারপর অনেক বছর পরে আবার জেগে উঠলো।তখন বিট্রিশ শাসন!
“- বিট্রিশ শাসন কি বাবাই!
“- আমাদের এই দেশ এই ভারতবর্ষ একসময় ইংরেজরা দখল করে নেয়।তাদের শাসনামলের সময়কেই ব্রিটিশ শাসন বলে।তোমরা যখন বড় হবে এ বিষয়ে জানবে।হুমম।
“- হুমম।তারপর কি হলো জাজিরার বাবাই!
“- তারপর! ব্রিটিশরা আবার এটাকে আবিষ্কার করে।সেই ব্রিটিশদের একজন সাধু ছিল তার নামেই জাজিরার নাম হয় সেন্টমার্টিন।
“- সেন্তমার্তিন! ও বাবাই আমাদের সেন্তমার্তিন? শৌর্য খুশিতে বলে ওঠে
“- হ্যাঁ বাবা! আমাদের সেন্টমার্টিন। এরপর এখানে আস্তে আস্তে বসতি গড়ে ওঠে।শুভা এতোক্ষন বসে সব শুনছিল।শুভা কিছু ভাবছে দেখে নীল প্রশ্ন করে বসলো,
“- কিছু জিজ্ঞেস করবে?
“- হুমম! আচ্ছা তখন থেকেই কি এ দ্বীপ সম্পর্কে সবাই জানে? কই আমি তো জানতাম না ভালোমতো?
“- আমি যদি বলি তুমি জানতে?
“- সত্যি জানতাম না।হয়তো শুনলেও এর সৌন্দর্য্য কথা এর কাহিনি কিছুই জানতাম না।
“- শুভা তুমি হুমায়ুন আহমেদের দারুচিনির দ্বীপ মুভিটা দেখেছ?
“- হ্যাঁ! হুমায়ূন আহমেদ তো আমার অন্যতম প্রিয় লেখক।স্কুলে থাকতে তার দারুচিনি দ্বীপ মুভির মন চাই মন চাই একটা গান আছে ওটা শুনতাম।অনেক পছন্দের মুভিটা।ঈদেও অপেক্ষা করতাম এই মুভির গানগুলোর জন্য। কিন্তু এটা সাথে ঐ টার কি সম্পর্ক
“- সম্পর্ক তো আছেই।কারন ঐ দারুচিনির দ্বীপ তো সেন্টমার্টিন। ছেঁড়াদিয়া গেছ?
“-সত্যি! না! নাম শুনেছি?
“- গেলে বুজতে তোমার মন চাই মন চাই গানটার আসল কাহিনি।তাছাড়া হুমায়ুন আহমেদের একটা বাড়িও আছে সমুদ্র বিলাস নামে।এরপর যখন আসবো তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাবো সব জায়গা।এবং সেটা খুব শীঘ্রই।
শুভা ভাবে সেই স্বপ্নের দারুচিনির দ্বীপের এতো কাছে এসেও শুভা জানতে পারলো না দেখতে পেলো না সেই দ্বীপটা মন দিয়ে।শুভা অবশ্যই দেখবে।নীলের হাতে হাত রেখে এলোচুলে ফুলের বেড়ি দিয়ে হেঁটে যাবে দূর বহু দূর।একান্তে কিছু সময় পার করবে।

চলবে,,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *