বধুবরন

বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 18

মেয়ের কথা শুনে নীল শুভা হাসতে হাসতে একে অপরের দিকে তাকাই।কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় দুজনের মাঝে।মেহেরাজ আম্মু এবং আব্বু কে মোবাইলে শুভার কথা বলতেই মায়া আসিফ টেকনাফ থেকে দ্রুত চলে আসে।শুভা হারানোর পর নীল রাগে মায়াকে সব বলে দিয়েছিল।বাড়িসুদ্ধ সবাই শুনে অবাক হয় শুভা মায়া আর শাহেদের সন্তান জেনে। নিজের মেয়ের সাথে এতো খারাপ আচরণ করায় নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না মায়া।কিছুদিন যেতে না যেতে ব্রেন স্ট্রোক করে বসে।রিকোভার হতে পুরো দুবছর লেগে গিয়েছিল।এখনও অতিরিক্ত চাপ পড়লে সব এলোমেলো হয়ে যায় মায়ার।আজ সকাল থেকেই শুভার কথা ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই সবার সাথে সেন্টমার্টিন আসতে পারে নাই।টেকনাফই রয়ে গেছে বিশ্রামের জন্য। মেহেরাজ কল করে সবটা জানালেই অসুস্থ শরীরে ছুটে আসে মেয়েকে দেখার জন্য। নীল শুভা পাশাপাশি দাঁড়ানো। মায়া ধীরে ধীরে ভাঙা জীর্ণশীর্ণ শরীরটা নিয়ে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখে আজ অনুশোচনা, মেয়েকে পাওয়ার আনন্দের জল উপচে পড়ছে।কন্ঠস্বর কান্নারজলে ভারী হয়ে আসছে মায়ার।তবুও বহু কষ্টে কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের কাধটা ধরে বলে,
“- মাগো!
শুভা পেছন ফিরে মায়াকে এমন অবস্থায় প্রথমে চিনতে পারে নি।ভ্রুকুচকে তাকিয়ে ছিল কিছুসময়।পাশে আসিফকে দেখতেই আসিফ অশ্রুচোখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে শুভার মাথায় হাত রাখে।শুভার চরম অস্বস্তি লাগছে এ দুজনের চোখের জল দেখে।মায়ার হাত টা কাঁধ থেকে সরিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“-কাঁদছেন কেন? আপনাদের উপর কোনো রাগ অভিমান নেই।তবে হ্যাঁ তাই বলে ভাববেন না সব ভুলে গেছি আমি। ভুলতে চাইলে আমার দুর্ষহ অতীত আমাকে ভুলতে দেয় না আপনাদের নিষ্ঠুর আচরণ গুলো।আমার সামনে না আসলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।
মায়া শুভার সকল কথা উপেক্ষা করে শুভাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে এমন কান্না জুড়ে দেয় যে পুরো বিয়ের আসর থমথমে হয়ে যায়।
“- ও মা! আমাকে মা বলে ডাকনা রে মা।আমি যে তোর হতভাগী গর্ভধারিণী মা।
শুভা মোটেও এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না।পৃথিবীতে বহু বাচ্চাকেই তাদের মা হয় পাপ ঢাকার জন্য না হয় গরিবির জন্য রাস্তায় ফেলে যায়।বাচ্চাগুলো রাতের আধারে হয় শেয়াল, কুকুর কিংবা শীতের কবলে পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে এই নিষ্ঠুর দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় নয়তো আশ্রয় পায় কোনো অনাথালয়ে।শুভার ভাগ্য ভালোয় তাই বড় মার মতো একজন ভালো মানুষের আশ্রয় মাথার উপর পেয়েছে।শুভার মনে কোনোদিন জন্মদাত্রী মাকে দেখার স্বাদ জাগে নি।কেন জাগবে? মা তো এমন করে না।মা নিজের সবকিছু বিলিয়েই না মা হয়।কিন্তু শুভার মা তো শুভাকে ফেলে গেছে শুধুমাত্র শুভার গায়ের রঙ কালো বলে।শুভার এমন মায়ের সন্তান বলে নিজেকে পরিচয় দিতেও লজ্জা বোধ করে।ওর মা! বড় মা ই।জন্ম দিলেই কি মা বাবা হওয়া যায়! না যায় না।শুভা ছোট বেলায়ই বুঝেছে মা কাকে বলে।ছোট বেলায় যখন কবিতা পড়েছিল- মা কথাটি ছোট্ট অতি। কিন্তু যেনো ভাই। মায়ের মতো আপন কেহ এ দুনিয়ায় নাই। শুভার জীবনে তো তখন বড় মাই আপন ছিল। তাহলে মা বড় মাই।যে শুভাকে জীবনের সকল চড়াই উৎরাইয়ে বুকে আগলে রেখে একটু একটু করে বড় করেছে।অর্থ কষ্টে তিনবেলা পেট পুরে খেতে দিতে না পারলেও ভালোবাসার কমতি রাখে নাই।শুভা আল্লাহর কাছে বার বার প্রার্থনা করেছে শুভার মা হিসেবে আল্লাহ যেন বড় মাকেই সম্মান দেয়।আর কোনো মায়ের দরকার নেই শুভার।শুভার ঘোর কাটলো মায়ার চুম্বনের স্পর্শে।মেয়ের গালে মায়া অতি আবেগে আহ্লাদে চুমু দিয়ে আবার বুকে টেনে নিল।শুভার আর সহ্য হলো না।ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল মায়াকে।আসিফ পেছন থেকে না ধরলে হয়তো পড়েই যেত মায়া।পুরো বাড়ির লোক সহ মায়া এতোদিন যে আশায় বুক বেধেছিল শুভার এ আচরণে সে আশা ভেঙে গেল।
“- মা! কিসের মা! কে মা! আমার মা তো ঐ বড় মা।বড় মা! বড় মা! মনিরা মা মেয়ের মিলন দেখে মুখে আচল গুজে আড়ালে দাড়িয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছিল।শুভার চিৎকারে এদিকে ছুটে আসতেই।শুভা সবার সামনে মনিরার হাত ধরে মায়ার সামনে নিয়ে দাঁড়ায়।মায়ের চোখে জল দেখে নীলের কোলে নুরভি আর শৌর্য কাঁদছিল। মেহেরাজকে দিয়ে নীল অনেক বুঝিয়ে দুজনকে নীলাশে পাঠিয়ে দেয়।শুভা সবার সামনে মনের এতোদিনের চেপে রাখা রাগ ক্ষোভ সব ঝাড়ে।
“-জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না মিসেস আসিফ আহমেদ।মা কাকে বলে আমাকে জিজ্ঞেস করুন!এই যে দেখছেন! এই গরিব মহিলাকে ইনিই আমার মা।এনাকে দেখলে মা বলে গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে।আপনাকে না।মা সন্তানকে নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও নিরাপদে রাখে আপনার মতো শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো বলে রাস্তায় ফেলে আসে না।আমার যে কষ্ট গেছে ফিরিয়ে দিন,আমাকে সুন্দর একটা ছোট্ট বেলা ফিরিয়ে দিন।দিন! আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে মা বলে ডাকবো।দিন না! আপনারা তিন জন( মায়া,মিরা, মালা কে দেখিয়ে) যখন আমাকে এই অজানা অচেনা জায়গায় লোক দিয়ে ধরে আনিয়েছিলেন আমার অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল জানেন! জানেন! না জানেন না।আপনি আপনার ঐ ১ সপ্তাহের বাচ্চাকে রাস্তায় শেয়াল কুকুরের মুখে ফেলে দেওয়ার পর ঐ বাচ্চার পরিস্থিতি যেমনটা ছিল তেমন।অসহায়ত্ব, চারপাশে শেয়াল কুকুরের লোলুপতা। কেউ ছিল না আমার পাশে। কেউ না।না আমার বড় মা।না আমার নীল।আমার চোখে শুধু শকুনদের ডানা ঝাপটানোর দৃশ্য ছিল।আমি যদি ঐদিন নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে মৃত্যুর মুখে ঝাপ না দিতাম আজ কি হতো আমার? বলেন! আজ আমার সন্তানদের ভবিষ্যত কি হতো?আমার নীলের সামনে আমি কি মুখ নিয়ে দাড়াতাম?এই দেখুন আমার রোম রোম দাড়িয়ে গেছে সেসব ভাবতেই।নীল ছুটে এসে শুভার মুখ চেপে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে।
“- হুশশশ! চুপ কর।নীলের চোখে জোয়ারের জল।শুভা শব্দ করে কেদে যাচ্ছে।
“- না নীল! বলতে দিন আমাকে।আমি আজ বলবো।এই মহিলা আমাকে জড়িয়ে মেয়ে বানাতে আসছে।ঐদিন কোথায় ছিল তার মাতৃত্ব? যেদিন আমাকে মেরে ডিভোর্স পেপার সাইন করিয়ে নিয়েছিল।আমার চোখের জলেও সেদিন তার মাতৃত্ব জাগাতে পারেনি।এই যে মিরা, মালা ফুপি।তারাও তো মেয়ে। মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে কি করে এমন করতে পারলো? ভয় করে না আপনাদের? ভয় করেনা উপরে একজন আছে তিনি সব দেখছেন।ঘুরে ফিরে ঐ বৃত্তের মধ্যবিন্দুতেই আপনাদের নিয়ে আসছে দেখলেন তো? আয়না নিজের বিভৎসতা সচক্ষে দেখানোর জন্যই বিধাতা আমাকে বাচিয়ে রেখেছে। আজ আমি চুপ থাকলে যে এরা পার পেয়ে যাবে।আমাকে বলতে দিন নীল।নীলের কাছে থেকে সরে শুভা আবার মায়ার মুখোমুখি হয়ে মিরা,মালাকে লক্ষ্য করে বলে,
সেদিন মৃত্যু জেনেও পানিতে ঝাপ দিয়ে প্রাণপণ বাঁচার লড়াই করে দূর্বল হাত পায়ে সাঁতরে বাচার চেষ্টা করেছি।অন্ধকারে গভীর পানিতে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে তীরে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি।বার বার শুধু বড় মা আর নীলের মুখটা ভেসেছে।আমি তো জানি নীল ভুল বুঝতে পারলে আমাকে পাগলের মতো খুঁজবে। আমাকে মৃত পেলে যে ও নিজেও মরে যাবে।এই দুটো মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে বাঁচার ফরিয়াদ জানিয়েছিলাম।আল্লাহ আমার ফরিয়াদ কবুল করেছিলেন বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সে যাত্রায়।বাচলাম কিন্তু মরার ভয়ংকর থাবা আমি বহুদিন ভুলতে পারি নি।সাহসে কুলোয় নি নীলকে জানানোর নীল আমি বেঁচে আছি।কোথাও একটা অভিমানও ছিল।নিজের ব্যথাটা তাকেও বোঝাতে চেয়েছিলাম। দেখি তার ভালোবাসার কতো জোর? খুজে বের করুক আমায়।নীলের হাত দুটো নিজের গালে চেপে কান্নার জল গলধকরণ করে শুভা আবার বলে,নীল আমার ভালোবাসার চিহ্ন যখন আমার গর্ভে এলো আমাকে জানান দিল মা আমরা আছি তো তোমার সাথে।বিশ্বাস করুন নীল! আমি ছুটে গিয়ে আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু ভয়ে বলিনি।যদি এরা আবার আমার এবংআমার সন্তানের ক্ষতির চিন্তা করে।আপনি যদি আবার আমাকে ভুল বোঝেন? আমি যে আর শক্তি সঞ্চার করে মৃত্যুর মুখ থেকে সাতরে আসতে পারবো না নীল।
নীল শুভা একে অপরকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে।শুভা নীলের চোখের জল মুখে আবার ফিরে দাড়ায়।
“- আমার সন্তান গর্ভে আসার পরই আমার সাহস,শক্তি দুটোই ক্রমশ বাড়তে থাকে।দিন রাতের পার্থক্য বুঝি নাই আমি মায়া খান।নিজের সন্তানদের ভবিষ্যত সুন্দর করার লড়াই করে গেছি।কেন করেছি এতো কষ্ট? আমিও তো পারতাম আপনার মতো রাস্তায় না হয় এই সেন্টমার্টিনের জলে আমার সন্তানদের ফেলে দিতে।ফেলি নি।আমি যে মা! মা হয়ে কি করে কেউ নাড়ি ছেঁড়া ধনকে আলাদা করতে পারে? আমি পারি নি।আপনার মতো লজ্জিতও হয়নি পিতার আশ্রয় পাবে না ভেবে।আমার সন্তান আমার আমার ভালোবাসার চিহ্নগুলোকে আমি সমস্ত ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে আগলে রেখেছি।ঠিক যেমন আমার বড় মা রাখতো।আপনি আমার সাথে ফেলে দেওয়া চিঠিতে লিখেছিলেন আমার দূর্ভাগ্য আমি আপনার গর্ভে জন্ম নিয়েছি আর তাই আমার এই পরিনতি।আমার পিতার কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিলেন আমার নাম শুভাসিনী জান্নাত হবে।কিন্তু আমি নাকি অশুভ, জাহান্নামসম ছিলাম আপনার জীবনে।এই অশুভ জাহান্নামকে তাই ছুড়ে ফেলেছিলেন রাস্তায়। আচ্ছা সেদিন কি কেদেছিলাম আমি? হয়তো কেদেছিলাম! আপনার মনে কি বিন্দুমাত্র মায়া জন্মায় নি ঐ ছোট্ট দুধের শিশুকে রাস্তায় ফেলে যেতে।জন্মাবে কি করে আপনি তো মা নন।শুধুমাত্র জন্মদাত্রী। আজ আমি বলছি সত্যি আমার দূর্ভাগ্য আমি আপনার গর্ভে জন্মেছি।আমার দূর্ভাগ্য আমি আমার বড় মায়ের গর্ভে কেন জন্মালাম না।বড় মার শুভা আমি।
“- শুভা মা!আমাকে ক্ষমা করে দে।আমি ভুল করেছি।মায়া শুভার দিকে হাত বাড়াতেই শুভা সরে যায়।
“- না! মা বলবেন না।ক্ষমা চাচ্ছেন কেন? আপনি কোনো ভুল করেন নি।আপনিই সঠিকই করেছেন।আপনার মতো সুন্দর মানুষের কোলে সত্যি আমি বেমানান ছিলাম।আমার পিতা কে আমি জানি না।তবে যেই হোক তাকেও বলে দিয়েন মানি না আপনাদের আমি পিতা মাতা।একটা মানুষের গড় আয়ু কতোদিন? ৫০/৬০ বছর! অর্ধেক জীবনে তো লাগেইনি আপনাদের পরিচয়।বাকি অর্ধেক জীবনেও বেজন্মা,অপয়া কথাটা ঠিক হজম করে যেতে পারবো।নীল চলুন! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে।চলুন নীল! শুভা নীলের হাত টেনে বড় মাকে নিয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে মায়ার সামনে।চোখের জল মুছে বলে,
“- মা বলি আর নাই বলি।সৃষ্টিকর্তা তো আপনাকে জন্মদাত্রী বানিয়েই দিয়েছেন আমার।তাই আমার বলা কথায় যে কষ্ট পেয়েছেন পারলে ক্ষমা করে দেবেন।জন্মদাত্রী হিসেবে এতোটুকু সম্মান আপনাকে আমি করবো।মা না ডাকি কিন্তু আজকের পর থেকে এমন আচরণ আর করবো না।ক্ষমা করবেন আমাকে।ভালো থাকবেন।
শুভা চলে যায়।মায়া আসিফের বুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে।সেদিন যদি মেয়েকে কষ্ট করে,সকল বাঁধা উপেক্ষা করে বুকে ধরে রাখতো তাহলে আজ শুভা মায়াকে মা বলে ডাকতে অস্বীকার করতো না।মাকে প্রত্যাখ্যান করতো না।
শুভাকে নীল এক হাতে বুকে সাথে আঁকড়ে নীলাশের সামনের একটা প্রবালের উপর বসে আছে।সামনে অথৈ জলরাশি।একটু পরপর তীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের মেলা। শুভা কেঁদেই যাচ্ছে। নীল শুধু একটু পর পর শুভার কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেও কাদছে।দূরে নুরভির কান্নার আওয়াজ আসতেই শুভা নীল চোখ মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।নুরভি কেঁদে চোখ মুখ কালো করে বাবাইয়ের কোলে এসে ঝাপিয়ে পড়ে।শুভা নীল মুখ চাওয়াচায়ি করে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে।ইতমধ্যে মেহেরাজ মুখটা বিষন্ন করে শৌর্য কে কোলে নিয়ে হাজির হয়।শৌর্যের মুখে হাসি।হাতে মোবাইল গেমস খেলতে খেলতে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে শৌর্য।নীল মেহেরাজের কে জিজ্ঞেস করলো,
“- কি রে নুরভি কাদছে কেন? বকেছিস?
“- আরে কি বলো? আমার কলিজার ভাগ্নিকে আমি কলিজা কেটে দিয়েও ভালোবেসে কূল পাবো না আর তুমি বলো বকছি নাকি?
মেহেরাজের কথা শুনে শুভা মেহেরাজের মুখের দিকে তাকাতেই মেহরাজ লজ্জা পায়।নীল আবার বলে,
“- তাহলে তোর কলিজার টুকরা ভাগ্নি কাদে কেন?
“- আসলে হয়ছে কি নীল ভাই! শৌর্যের মোবাইল গেমস পছন্দ হওয়ায় ওকে এটা আমি দিয়ে দিয়েছি।নুরভি লাভলি আপুর কাছেই ছিল তখন।শৌর্য আমার পাশে বসে খেলছিল তখন নুরভি এসে দেখে শৌর্য গেমস খেলছে।ও অনেকক্ষণ আগ্রহ ও কৌতুহল নিয়ে শৌর্যের খেলা দেখে মোবাইল টেনে নিয়ে খেলতে চাই।শৌর্য একবার ওকে খেলতে দিয়ে আবার নিয়ে নেয়।এতেই রেগে যায় নুরভি।তার এই জিনিস চাই ই চাই।আমি বলেছি বিকেলেই এনে দেব।কিন্তু ও এটাই নেবে।শৌর্য কে বলেছি ও দিচ্ছে না।মেহেরাজের কথা শেষ না হতেই নুরভি নীলের কোল থেকে ঝাপ দিয়ে মেহেরাজকে আক্রমণ করে বসে।মেহেরাজের চুল টেনে খামচে একাকার করে বলে,
“- তুই একটা পাজি মামু! শৌর্যের ডিম পচা মামু।আমারে গেম দে। দে! দে!
নীল শুভা নুরভিকে টেনে সরায় মেহরাজের থেকে।শুভা মেহেরাজের দিকে তাকিয়ে দেখে বেচারার চুলগুলো টেনে এলোমেলো করে নাক মুখ গলায় খামচির দাগ বসিয়ে দিয়েছে নুরভি।শুভার খুব কষ্ট লাগছে মেহেরাজের কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে।নীল আপ্রাণ চেষ্টা করছে নুরভিকে থামানোর।কিন্তু এই মেয়েকে শান্ত করাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামানোর সমান।
“- বাবাই! এমন করে না।তুমি না আমার লক্ষি বাবাই।
“- না আমি লক্ষি না! আমার গেম দে! এই শৌর্য দে আমারে।
“- না! মামু আমাকে দিয়েছে।এটা আমার।তোকে তো দিলাম একবার খেলতে।মেয়ে মানুষ গেম খেলে না।কুতকুত খেলে।যা কুতকুত খেল।শৌর্য জিহ্বা ভেংচে নুরভির রাগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
“- শৌর্যের বাচ্চা! রাস্তার থেকে টুকাই পাওয়া বলদ! লেজ ছাড়া কুত্তা! দে গেম দে!
“- তুই! তুই!দেবো না ভাগ।
“- আমারে গেম দে! বাবাই গেম দে!
“- আম্মু তোমাকে আমি বিকেলেই গেমস এনে দিব।তুমি কেদো না।মেহেরাজ এগিয়ে আসতেই নুরভি আবার বাঘের মতো থাবা মারতে যাই।নীল তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেয় নুরভিকে।
“- তুই একটা পচা মামু! আমাকে গেম দিলি না কেন? এই বিছানায় হিসু করা মুতুনি রে কেন দিলি? তোকে মেরে ভর্তা বানাবো।আমারে গেম দে! গেম দে!
শুভা এতোক্ষন ধরে নুরভির আচরণ দেখছিল।রাগে শুভা নুরভিকে ধমক দিল।
“- এই বেয়াদব! এমন করছিস কেন? থাম! মামু তো বললো এনে দেবে।
“- না আমার এখনই চাই।ঐটা শৌর্যকে দিও।এটা আমাকে দাও মাম্মী।
“- বলেছি না চুপ কর! কান্না থামা।মামার মুখ খামচে কি করেছিস? দেই তোকেও এভাবে খামচে?
“- এঅ্যাআআআ! আমারে গেম দেয় না।আবার খামচি দিতে চাই।আমি মরে যামু।
“- ছি! মা এসব বলতে নেই।আর শুভা! ও ছোট মানুষ ধমক দিও না।বুঝিয়ে বলো
“- আরে আপনি থামেন।পাজির পা ছাড়া একটা বদ এইটা।এমন জেদ কেন তোর? বলছি না বিকেলে পাবি।বিকেলেই পাবি।বেশি ভ্যা ভ্যা করবি তো কোনোদিন কিছু দিবো না।
“- নাআআআআ! আমার এখনই চাই! দে! দে!বাবার কোলো হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
শুভা রাগ ধরে রাখতে না পেরে ঠাস করে নুরভির গালে চড় বসিয়ে দেয়।
“- বেয়াদব ছেরি! কখন থেকে বলছি থাম থামে না।আরেকবার কেদে দেখা তো সাহস থাকলে।বড়দের সাথে বেয়াদবি করিস? কত্তবড় সাহস তোর।মাফ চা মামার কাছে।মাফ চা!
“- আহ শুভা! কি করছ?
“- শিক্ষা দিতে দিন।অতিরিক্ত শুরু করছে।এই নুরভি! মাফ চা।নুরভির দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে।
“- আপু লাগবে না।ও তো ছোট!
“- মেহেরাজ চুপ করো।ছোট থেকেই বড় হওয়ার শিক্ষা পেতে হবে ওকে।নুরভি! নীল নামান কোল থেকে।নীল চুপচাপ নামিয়ে দিতে গেলে নুরভি বাবার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ফুপাতে থাকে।শুভা নীলের বাঁধা উপেক্ষা করে টেনে নুরভিকে নিচে দাড় করায়।
“- সরি বলো মামাকে।আর নিজ হাতে মামার গায়ে ওষুধ লাগিয়ে দেবে।সরি বলো
“- সরি মামু! আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি তো ছোট বাচ্চা তাই ভুল করে রেগে যায়।রেগে গেলে মাথার তার ছিড়ে যায় তখন সবাইকে খামচি দি।তোমাকেও দিয়ে ফেলছি।তুমি কষ্ট পেয়ো না মামু।মেহেরাজের দিকে ছলছল চোখে কেঁদে বলে নুরভি।মেহেরাজ নুরভিকে কোলে নিতে গেলে শুভা বাধা দেয়।
“- এবার কান ধরে উঠবস কর দশবার।
“- মাম্মী মাফ তো চাইলামই।
“- এই টুকু মাফে কি হয়? তোকে আরও শাস্তি পেতে হবে।যেন পরেরবার এমন বেয়াদবী করতে গেলে তোর মনে পড়ে মাম্মী কি করবে?কান ধর।
“- মাম্মী!
“- ধরবি না কঞ্চি নিয়ে আসবো?
“- ধরছি ধরছি।
“- শুভা বেশি হয়ে যাচ্ছে। সরো! আম্মু আসো।নীল নুরভিকে কোলে তুলে আদর করতে থাকে।মেহেরাজও নুরভির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।শৌর্য বোনকে থাপ্পড় খেতে দেখে নিজেও মামার কোলে কাঁদে। নুরভির দিকে গেমস টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“- নে বোন তুই ই নিয়ে নে।আমার লাগবে না।
নুরভি খপ করে গেমস টা নিয়ে কান্নাভেজা চোখেই হি হি হি করে হেসে দেয়।
“- সেই তো দিলি বান্দরের বান্দর! শুধু শুধু মাম্মীর চটকানি খাওয়ালি।দেখিস তোর গেমস আছড়ে আছড়ে ভেঙে ফেলবো।ঐ মামু বিকেলেই আমারে গেমস এনে দিবি।
নুরভির কথা শুনে সব হা হয়ে যায়।শুভা নীলের দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়ায় মেয়ের কথায়।শৌর্য এবার মত পাল্টে ফেলে নুরভির গেমস ভেঙে ফেলার কথা শুনে। আবার গেমস ফেরত চাই,
“- নুরভি আমার গেমস ফেরত দে! তুই খারাপ।দে ফেরত দে
“- নিবি! নে নে।যা ভাগ।দেবো না।ভেঙে কটকটি খাবো।হি!হি!হি!
“- মাম্মী! আমার গেমস দেয় না নুরভি।এবার মেহেরাজের কোলে চিংড়ি মাছের মতো হাত পা ছড়িয়ে কাঁদে শৌর্য।
“- উফ! যা খুশি কর।আমার কি।গেলাম আমি।
“- এই শুভা! আমাকে একা রেখে কই যাও।
“- এতোদিন আমিও একা সামলেছি।আপনিও অভিজ্ঞতা নিন আপনার ছেলেমেয়ের ভালোবাসার।৪ টা নাকি সামলাতে পারবেন একসাথে তো ২ আগে সামলে দেখান?
“- চ্যালেঞ্জ করছ? দেখো পরে না পস্তাতে হয়?
“- সে পরের হিসাব পরে দেখা যাবে।আগে বর্তমানের হিসেব ঠিক করেন।মেহরাজ আমার সাথে এসো ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি। মেহরাজকে নিয়ে শুভা চলে গেল ভেতরে।যাওয়ার সময় নাক কুঁচকে নীলকে বুঝিয়ে গেল ঠেলা সামলান বিচ্ছু দুটোর।নীল নিচে গড়াগড়ি করা শৌর্য আর কোলে দাঁত বের করে হাসা নুরভির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।নুরভি বাবাইয়ের তাকানোর দৃষ্টিভঙ্গি আরও করুন করে দিল হাতের গেমস টা পানিতে ছুড়ে ফেলে।তা দেখে শৌর্য এবার গলার শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বালুমাখামাখি করে কাঁদছে আর নুরভি খুশির ঠেলায় বাবাইয়ের গালে পাপ্পি দিচ্ছে। নীল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।এক দিকে মেয়ে অন্য দিকে ছেলে? আরে টুইনের কি সুখ রে নীল!বাবাইকে চুপ থাকতে দেখে নুরভি বললো,
“- বাবাই তোমার কি কাঁদতে ইচ্ছে করছে?
“- তুমি কি করে বুঝলে মা?
“- মাম্মী বকলে আমারও কান্নার আগে মুখটা তোমার মতো হয়ে যায়।এই এখন যেমন করে রেখেছ মুখ।মাম্মী বলে তখন নাকি জ্যাকের মতো লাগে আমাকে।ও বাবাই জ্যাক কি?
“- কিইইই।( বোকা বোকা চেহারা বানিয়ে)
“- হ্যাঁ তো! আমি আয়নায় একদিন কান্নার আগে নিজের মুখ দেখেছিলাম।ঠিক জ্যাক ফেস লাগছিল।ও বাবাই তোমার মুখটাও তো জ্যাকফেস হয়ে গেছে।বাবাই মাম্মীকে জিজ্ঞেস করো না জ্যাকফেস কি? সুন্দর বা পচা?
“- মা রে আর বলিস না চুপ কর! না হলে সত্যি এবার কেঁদে হাতি ফেস বানিয়ে ফেলবো আমি।শৌর্য বাপ আমার! ওঠ বাপ! ধুলো ময়লা খারাপ জিনিস! আমার শৌর্য ভালো তাই না? বাবাইয়ের কথা শোনে।ওঠ বাবা!
“- না! আমার গেমস দে! নুরভি বুড়ি একটা।তোর চুল টেনে ছিঁড়ব আমি।আমার গেমস দে!
“- ও বাবাই! হাতির ফেস কি? এই যে শৌর্য কাঁদছে এমন ফেস বাবাই।ও বাবাই বলো না বাবাই।
“- শুভা! ও শুভা!
“- কি হলো! ৪ টার প্লান শুরু করবো?
“- আরে মাফ চাই! উদ্ধার করো আমাকে।
“- পারবো না!নিজে উদ্ধার হন।
“- ও বাবাই! বলো না।
“- চুপ! কি বলোনা বলো না শুরু করছ? চুপ থাকো।
“- এঅ্যাআআআ! বাবাই তুমি পঁচা! মাম্মী বাবাই আমাকে ধমক দিয়েছে মাম্মী! নীল কপাল চাপড়ে মাটিতে বসে পড়ে নুরভির চিৎকারে।

চলবে,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *