দৃষ্টির বাহিরে

দৃষ্টির বাহিরে !! Part-05

নীলের মুখ দেখতেও আমার এখন ঘৃণা করছে। নীল যে এত খারাপ সেটা কি ইরফানি জানে?
হয়তোবা জানে না, জানলে এরকম একটা অমানুষকে ভালোবাসত না।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ইরফানিকে সব সত্তিটা বলবো, আমি একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারিনা!
আমি ইরফানিকে কল করে আবার আমার সাথে দেখা করতে বললাম।

কেন ডেকেছো আমাকে জয়া? নিজের সিদ্ধান্ত কি বদলে ফেলছো? সিদ্ধান্ত বদলালে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

দেখুন আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলাই নি, আর আমি নীলের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। সে জন্যে ডেকেছি।

কি বলবে?

নীল আসলে একজন অমানুষ! ও মিমি নামের একটা মেয়েকে খুন করেছে, প্রথমে ওর সাথে শারিরীক সম্পর্ক করে তারপর মিমি যখন প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় তখন মিমিকে খুন করে নীল ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড ফয়সালকে ফাঁসিয়ে দেয়।

আমার এসব কথা শুনার পর ইরফানির কোনো আক্ষেপ দেখছি না। কিছুক্ষন পর ইরফানি বলল,

তোমার কি মনে হয় আমি নীলের ব্যাপারে জানিনা? আমি সব জানি মিমির সাথে কি হইছে আর না হইছে।

আপনি জানেন? তাহলে নীলকে এসব করা থেকে আটকাননি কেনো?

নীলকে আমি ভালোবাসি। নীল জেলে যাবে সেটা আমি কিভাবে হতে দিতাম, আর মিমির কথা বলছো? ও তো একজন দুশ্চরিত্রা ছিলো। ওর এটাই হওয়া উচিত ছিলো। আর ফয়সাল সে কেন নীলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? ওদের সাথে যা হয়েছে সব ঠিক হয়েছে।

কি বলছেন এসব আপনি? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের নামে এসব বলতে আপনার বিবেকে বাধঁছে না??

না বাধঁছে না। আর এসব হাইক্লাস ব্যাপার স্যাপার, তোমার মতো আনকালচার, খ্যাত মেয়ে এসব বুঝবে না। আর তুমি কি ভাবছো এসব বলে তুমি নীলের প্রতি ঘৃণা করাবে? পারবে না। চুপচাপ নীলের জীবন থেকে চলে যাও। আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না।

হ্যাঁ, চলে যাবো! নীল আমাকে খুনের চেষ্টা করেছিলো, আমি তারপরও ভেবেছিলাম আমি ওর সাথে থাকবো কারন আমার মনে হয়েছিলো নীলের ভেতরে একটা ভালোমানুষ আছে, হয়তবা আমার ওপর রাগ করে আমার পেটে ছুরি চালিয়েছে কিন্তু না! ও একটা অমানুষ।

ও মানুষ হোক বা মানুষ সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, আমার নীলকে ছেড়ে শুধু চলে যাও।

আমি নীলকে ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। তার আগে নীলের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখলাম,

নীল,
আমি তোমাকে একজন ভালোমানুষ ভাবতাম। তুমি আমার পেটে ছুরি চালিয়ে দেওয়ার পরও আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, কখনো তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কল্পনাও করিনি। তুমি চেয়েছিলে আমি তোমার সাথে সব ঠিক করেনি, আমি সেটাও মেনে নিয়েছিলাম। পরে জানলাম ইরফানি তোমার জীবনে ফিরে আসতে চায়! ইরফানি আমাকে হুমকি দেওয়ার পরও আমি তোমাকে ছাড়তে চাইনি! কিন্তু আজ আমি চলে যাবো, কেন জানো?
কারন তোমার সত্তিটা আমার সামনে চলে এসেছে, তুমি অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছো! এমনকি খুন!
তারপর নিজের নির্দোষ বন্ধুকে ফাঁসানো! তুমি হয়ত চিঠিটা পর ভাববে আমি এসব কিভাবে জানলাম? আমি লুকিয়ে তোমার ডায়রি পড়েছি।
তুমি আমার চোখে ঘৃণা দেখতে চেয়েছিলে না? আজ তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। হ্যাঁ ঘৃণা করি আমি তোমাকে। I hate you Nil. আর আজ আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। আর এটাই হবে তোমার জন্মদিনের সবচেয়ে বড় গিপ্ট! ইরফানির সাথে ভালো থেকো।

ইতি
জয়া।

চিঠিটা আমার টেবিলের ওপর রেখে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।
আমি জানিনা আমি কোথায় যাবো এখন! কারন আমার আপন বলতে কেউ নেই।

আব্বু আম্মুর কাছেও যেতে পারবোনা। কারন তারা কেউ বেঁচে নেই।

আমার মনে পড়লো আমার বান্ধাবী মিরার কথা! মিরাকে সব খুলে বললাম, ও আমাকে ওর বাসায় থাকতে জায়গা দিলো! কিন্তু কতদিন আর এভাবে থাকা যায়? তাই আমি চাকুরী খুঁজতে লাগলাম। এর মধ্যে নীল আমাকে অনেকবার কল করেছে! কিন্তু আমি কখনো কল রিসিভ করিনি। নিজের ফোন বন্ধ করে রাখলাম।

এর মধ্যে একটা চাকুরীও যোগাড় করে ফেললাম! এবার একটা বাসা খোঁজার পালা।

আমি সেদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম হঠাৎ ওই বৃদ্ধলোক টার সাথে আমার দেখা হলো যাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।

আনকেল আপনি? এখন কেমন আছেন?

আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। সেদিন যদি তুমি না থাকলে!

কি যে বলেন না আনকেল। আমি কিছুই করিনি। সবই আল্লাহর ইচ্ছে!

তা মা কোথায় যাচ্ছো?

অফিসে থেকে ফিরছি আনকেল।

ওহ! তোমার স্বামী কেমন আছে মা? সেদিন তো স্বামীর জন্যে চলে গিয়েছিলে!

জানিনা।

মানে?

আমি ওকে ছেড়ে চলে এসেছি আনকেল, অমানুষ ছিলো একটা।

মা আমি বুঝতে পারিনি! এখন কোথায় থাকো?

বান্ধাবীর বাসায়!

আমাদের বাসায় চলো আজকে, তোমার আন্টি তোমাকে দেখতে চেয়েছি। তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।

আমি আনকেলের সাথে আনকেলদের বাসায় গেলাম। বাসাটা অনেক বড়। আর অনেক সুন্দর।

আমি আনকেলকে বললাম, আনকেল আপনার বাসাটা খুব সুন্দর।

সবই তোমার আন্টির জন্যে।

আন্টি আমাকে দেখে আনকেল কে জিজ্ঞেস করলো এই মেয়েটা কে?

আরে, তোমাকে বলেছিলাম না! সেদিন এক্সিডেন্ট এর পর এই মেয়েই তো আমাকে বাঁচিয়েছিল।

ও, তুমি সে? নাম কি তোমার মা?

জ্বী আন্টি, জয়া।

বাহ! মিষ্টি নাম।

বসো, আমি তোমার জন্যে নাস্তার ব্যবস্থা করি।

না আন্টি দরকার নেই।

অবশ্যই আছে, তুমি প্রথমবার এসেছো আমাদের বাসায়।

আন্টি রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি ড্রয়িংরুমে বসে আছি। আমি আনকেলকে প্রশ্ন করলাম,
আচ্ছা আনকেল আপনাদের বাসায় কি শুধু আপনারা দুজন থাকেন?

হ্যাঁ মা। আমরা দুজনই থাকি! আমার তোমার আন্টি ছাড়া আর তোমার আন্টির আমি ছাড়া কেউ নেই।

আপনাদের ছেলেমেয়েরা?

নেই!

ঠিক বুঝলাম না।

একটা ছেলে ছিলো কিন্তু সে আমাদের কাছে মৃত।

আমি আর আনকেলকে এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলাম না!
এর মধ্যে আন্টি চলে এলেন নাস্তা নিয়ে।
আমি বললাম,

আন্টি এতো কিছুর কি দরকার ছিলো?

দরকার ছিলো মা।

হঠাৎ আন্টি আমাকে প্রশ্ন করলো, মা তোমার স্বামী কি করে?

আনকেল আন্টিকে বললেন, আহ! কি করছো! এসব কথা বাদ দাও।

না আনকেল, আসলে আন্টি আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছি!

কেন মা?

অমানুষ ছিলো একটা! একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। একটা মেয়েকে খুন করেছে। তার সাথে কিভাবে থাকতাম?

ভালো করেছো মা। তোমাকে দেখেই বোঝা যায় তুমি অনেক ভালো। তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে। এখন কোথায় থাকছো?

বান্ধাবীর বাসায়। তবে এখন যখন চাকুরী করছি তখন নিজের জন্যে আলাদা বাসা দেখবো! কতদিন আর বান্ধাবীর বাসায় থাকবো।

আমাদের বাসায় থাকতে পারো।

না আনকেল। ধন্যবাদ। আপনাদের ওপর আর বোঝা হতে চাই না।

বোঝা কেন হবে মা? তুমি থাকলে আমাদের ভালো লাগবে।

কিন্তু!

কোনো কিন্তু না! তুমি আমাদের মেয়ের মতো। তাই আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে।

ঠিক আছে আনকেল।

আমি যেন একটা নতুন জীবন পেলাম, নতুন করে বেঁচে থাকার মানে পেলাম।

এভাবে ভালোই কাঁটছিলো আমার দিন।
আনকেল আন্টি আমাকে আপন করে নিয়েছিলো। যেন আমি উনাদের নিজের মেয়ে। আমি নতুন করে বাবা-মা পেলাম।

হঠাৎ একদিন একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলো।

আমি রিসিভ করতেই সে বলল, তুমি কি জয়া?

জ্বী! আপনি কে?

আমি নীলের মা বলছি!

আপনি?

হ্যাঁ, তোমাকে কিছু জানানোর আছে।

জ্বী বলুন।

সেদিন যখন তুমি আমাদের বাসায় এসেছিলে, সেদিন আমরা তোমাকে মেনে নেই নি। আমরাই ইরফানিকে ফোন করে নীল আর তোমার কথা বলি। তুমি যখন বলেছিলে তোমরা ভালো নেই, তাই আমরা ভেবেছিলাম নীল ইরফানির সাথে ভালো থাকবে, আর তাই আমরা সেদিন নীলের সাথে দেখা করতে আসিনি।

এসব বলে কি লাভ আন্টি? যা হবার তা তো হয়েই গেছে! আর আমি তো নীল আর ইরফানির জীবন থেকে সরেই এসেছি।

ভূল টা তো এখানেই হইছে!

ভূল? কিসের ভূল। আন্টি আপনার কথা আমি বুঝলাম না।

আমরা নীলের জন্মদিনে নীলের সাথে দেখা করতে যাই, তখন জানতে পারলাম তোমার সাথে যার বিয়ে হয়েছে সে আদও নীল না। নীলের বন্ধু ফয়সাল!

মানে? কি বলছেন এসব?

ঠিকই বলছি।

তাহলে নীল কোথায়?

জানিনা। আমাদের পাপের শাস্তি আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের ক্ষমা করে দিও মা।

আপনার সাথে আমি পরে কথা বলছি! বলে ফোনটা কেটে দিলাম। আমার অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। আমার এক্ষুন বাসায় যেতে হবে।

আমি বের হচ্ছিলাম এমন সময় আন্টি এসে বললেন, কোথায় যাচ্ছো মা?

আন্টি আমি বাসায় যাচ্ছি। অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। এখন না গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

কি হবে? বলে তো যাও।

ফিরে এসে বলব।
আর কোনো কথা না বলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসায় এসে দেখি ও বসে আছে। আমাকে দেখতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
কোথায় চলে গিয়েছিলে জয়া? আমি তোমাকে ছাড়া কত কষ্টে ছিলাম জানো? একবার তো ফোনটা রিসিভ করতে পারতে।

তুমি কে?

আমি কে মানে?

আমি তোমার স্বামী!

তুমি আমার স্বামী সেটা আমি জানি কিন্তু তোমার আসল পরিচয় কি?

আমি নীল।

তুমি নীল নও মি. ফয়সাল! আমি সবটা জেনে গেছি! কেন এমন করলে আমার সাথে? আর নীল এখন কোথায়?

চলবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *