দৃষ্টির বাহিরে

দৃষ্টির বাহিরে !! Part-04

আমি সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। নীলকে হারানোর ভয় হচ্ছে আমার খুব।

সকালে নীল অফিসে যাওয়ার পর আমিও ইরফানির পাঠানো ঠিকানায় গেলাম। আমি কফিশপের ভেতরে গেলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলাম ইরফানি এলো, দেখতে খুব একটা ফর্সা নয়! চুলগুলো ছোট করে কাটা, জিনস আর টপস পড়া। ওকে চিনতে আমার দেরি হলো না কারন ওর ছবি দেখছিলাম। আর নীলের ডায়রির বর্ণনা অনুযায়ী বুঝলাম ওই ইরফানি!

জয়া? রাইট?

হুম।

নীল হঠাৎ তোমার মতো পর্দাশীল, খ্যাত মেয়ের মধ্যে কি দেখলো? বুঝলাম না! সারাদিন এসব বোরখা, হিজাব পড় নাকি? চেহারা খারাপ সেটা বোরখার নিচে লুকিয়ে রাখো? নীলের পছন্দ দেখছি আজকাল বদলে গেছে। না জানি নীল কিভাবে তোমার সাথে থাকে!

এক্সকিউজ মি আপু, কারো পোশাক নিয়ে কথা বলার অধিকার কারো নেই। মেয়েরা কোনো ভোগ্যপণ্য নয়, যে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে হবে। আর আপনি যদি মনে করেন আমি অশিক্ষিত তাহলে ভুল ভাবছেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেছি। আর এমনও হতে পারে আমার চেহারা দেখে আপনার পায়ের তোলার মাটি সরে গেল!

ইরফানি আমার কথায় তাচ্ছিল্য এর একটা হাসি দিলো! বাই দ্যা ওয়ে, যে জন্যে তোমাকে ডেকেছি!

হুম কেন ডেকেছেন?

নীলের জীবন থেকে সরে যাও। নীল শুধু আমাকে ভালোবাসে।

আমি নীলের জীবন থেকে যাবো না, আমি ওর স্ত্রী।

স্ত্রী? কিসের স্ত্রী? আমি ওর ভালোবাসা!

আপনি ওর ভালোবাসা ছিলেন, এখন নেই, নীল শুধু আমাকে ভালোবাসে।

আমার কথা শুনে ইরফানি হাসতে শুরু করলো। তারপর নিজের ফোন থেকে নীলকে কল দিলো,

হ্যালো ইরফা? বেবি তুমি জানো তো আমি কত ব্যস্ত থাকি! এত ফোন দাও কেন?

বাবু, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। আমাকে কবে বিয়ে করবে?

করবো, করবো! এত তাড়া কিসের তোমার?

তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না।

ওকে বেবি বাই। উম্মাহ…

যা দুষ্টু, বাই।

দেখলে তো? ও এখনো আমাকেই ভালোবাসে!

আমি বিশ্বাস করিনা।

সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি তো নীলকে আমার করে ছাড়বো!
কথাটা বলে ইরফানি চলে গেল!
নীল কি সত্যি এখনো ইরফানিকেই ভালোবাসে?
তাহলে আমার সাথে কেন এত ভালো ব্যবহার করছে? কেন আমাদের সম্পর্ক ঠিক করার কথা বলছে? তবে কি সবটাই মিথ্যে? আমাকে নীল ঠোকাচ্ছে না তো?
কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

বাসায় বসে আছি, নীল আর ইরফানির কথাগুলো কানে বারবার বাজছে!
হঠাৎ নীল এসে বলল,
কি হইছে জয়া? এত চুপচাপ কেন?

কিছু না!

আমাকে বলো।

তেমন কিছু না! আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?

হুম।

তুমি কতজনকে ভালোবেসেছো মন থেকে?

আমার প্রশ্ন শুনে নীল হাসতে লাগলো!

হাসছো কেন?

তোমার কথা শুনে!

আমি কি কোনো হাসির কথা বলেছি?

না। এমনি

উত্তরটা দাও।

সত্যি বলব?

হ্যাঁ।

একজনকে। যাকে প্রথমবার দেখেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম! যাকে কষ্ট দিলে আমার চোখে পানি এসেছে। যার সাথে সারাজীবন কাটাতে ইচ্ছে করে। যে সাথে থাকলে মনে হয় দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যাই।

এখনো তাকেই ভালোবাসো?

নীল মুচকি হেসে বলল, একবার যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো ভুলা যায় না।
কিন্তু তুমি আমাকে কেন এসব জিজ্ঞেস করছো?

না এমনি। কথাটা বলেই রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে লাগলাম! তারমানে নীল এখনো ইরফানিকেই ভালোবাসে। হে আল্লাহ আপনি বলে দিন আমি কি করবো?

অনেকভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম নীল আর ইরফানির জীবন থেকে সরে যাবো। আমি ইরফানিকে কল দিয়ে বললাম,

আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, জয়া! আমি জানতাম তুমি আমাকে কল দিবে। তা কি সিদ্ধান্ত নিলে?

আমি সরে যাবো নীলের জীবন থেকে।

That’s like a good girl.

আমি ফোনটা কেটে দিলাম, খুব কষ্ট হচ্ছে, এতটা কষ্ট তখনও হয়নি যখন নীল আমার পেটে ছুরি মেরেছিলো।

নীল অফিসে গেলে আমি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।
স্টোর রুমে আমার কিছু জিনিষ রয়ে গেছিলো, সেখানে জিনিষগুলো নিতে গিয়ে হঠাৎ নীলের ডায়রিটা চোখে পড়লো, আমি নীলের ডায়রিটা হাতে নিতেই সেখান থেকে একটা মেয়ের ছবি পড়লো! সাথে ২টা ছেলেও ছিলো! তারমধ্যে একটা নীল। কিন্তু মেয়ে টা ইরফানি নয়!
সেদিন তো আমি ছবিটা খেয়াল করিনি, ভাবতেই মনে পড়লো, আমার তো পুরো ডায়রিটাই পড়া হয়নি।
ডায়রি আর ছবিটা নিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম!
আমি ডায়রিটার বাকি অংশটা পড়া শুরু করলাম।

“ইরফানি বিদেশে চলে যাওয়ার পর আমাদের কলেজে মিমি নামের একটা মেয়ে এলো। খুব ফর্সা, চোখগুলো টানা টানা, চুলগুলো বেশি লম্বা নয়। অসম্ভব সুন্দরী। যেকোনো ছেলে দেখলে প্রেমে পড়ে যাবে।

আমার নজর পড়লো মিমির ওপর। মিমিকে আমার প্রেমে ফেলানোর জন্যে অনেক কিছু করি কিন্তু মিমি কিছুতেই প্রেম করতে রাজি হয়না। মিমি ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।
প্রতিদিন মিমির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ওকে কোনো ছেলে কিছু বললে তাকে প্রচুর মারতাম, মিমিকে বিভিন্ন নোট দিতাম।

আস্তে আস্তে মিমিও আমার প্রেমে পড়ে গেলো। মিমি আর আমার প্রেম ভালোই চলছিলো। মিমির সাথে আমার শারিরীক সম্পর্ক গড়ে তুলি। এর মধ্যে ইরফানি বিদেশ থেকে ফিরে আসে। আমি মিমির সাথে ব্রেকাপ করে ফেলি কিন্তু মিমি আমাকে ছাড়তে রাজি নয়। কারন মিমি প্রেগন্যান্ট ছিলো।
ওকে অনেক বুঝালাম। কিন্তু ও বুঝতেই চাইছিলো না, এদিকে ইরফানি যদি জানে আমার আর মিমির সম্পর্কের কথা তাহলে আমি ফেঁসে যাবো। ইরফানি আমাকে বিয়ে করবে না। তাই মিমিকে বললাম, বাচ্চাটা নষ্ট করতে কিন্তু সে কিছুতেই বাচ্চাটা নষ্ট করবে না।
কি করবো বুঝতে পারছিলাম না! হঠাৎ করে মনে হলো ফয়সালের কথা! ফয়সাল ছিলো আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড, সেই ছোটকাল থেকেই। ও মেডিকেলের স্টুডেন্ট। ভাবলাম ওর থেকে পরামর্শ নিবো।
ফয়সালকে আমি মিমির কথা বললাম। কিন্তু ও শুনে বলল, ও মিমির সাথে দেখা করবে। তারপর আমরা সবাই বসে একটা সিদ্ধান্ত যাবো।
কিন্তু আমি জানতাম না মিমির জন্যে ফয়সাল এতটা বদলে যাবে। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও ও মিমিকে সাপোর্ট করতে লাগল! ফয়সালও আমার বিরুদ্ধে চলে গেল।
তখন আমার মাথায় একটা প্লান এলো। আমি ফয়সালের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম।

আমি মিমিকে ডাকলাম আমার সাথে দেখা করার জন্যে।
মিমি এলো, আমি মিমিকে বিয়ে করবো কিন্তু একটা শর্তে, সে যদি আমার কথা শুনে চলে।
মিমি অসহায় ছিলো আমার কথায় রাজি হয়ে গেলো!
আমি মিমিকে বললাম, ও যেন আমার কথা মতো একটা চিঠি লেখে।

চিঠিটা ছিলো এই যে, ফয়সাল ভাইয়াকে আমি আমার নিজের ভাই মনে করতাম, কিন্তু ও আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে জোর করে, আর আমার পেটে বাচ্চা চলে আসে কিন্তু ফয়সাল ভাইয়া বাচ্চাটাকে মেনে নিতে চাচ্ছে না।”

মিমি কিছুতেই চিঠিটা লিখতে চাইলো না। কিন্তু আমি ওকে ভয় দেখালাম। ও যদি এটা না করে তাহলে আমি ওকে আর বাচ্চাকে মেরে ফেলবো। তাই ও রাজি হয়ে গেল।

পরেরদিন মিমির বাসায় লুকিয়ে ঢুকে ওকে ঘুমের মধ্যে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেই। আর চিঠিটা মিমির টেবিলে রেখে চলে আসি। আর ফয়সাল মিমির আত্মহত্যার জন্যে ফেঁসে যায়।

ফয়সালের বিশ্বাসঘাতকতার এটাই শাস্তি ছিলো, ও কিভাবে আমার বন্ধুত্ব বাদ দিয়ে ওই মেয়ের কথায় আমার বিরুদ্ধে যায়? তারপর ফয়সালকে ওর বাবা-মা বাসা থেকে বের করে দেয়। আর পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায়।
তারপর ফয়সাল আর আমার কখনো দেখা হয়নি।”

ডায়রির বাকি অংশ পড়ে আমি কেঁদে ফেললাম! নীল এতটা খারাপ ছিলো? ছিঃ! মিমি মেয়েটা তো নির্দোষ ছিলো! আর ফয়সাল! সেও নির্দোষ ছিলো। নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডকে এইভাবে যে ফাঁসাতে পারে সে অমানুষ ছাড়া কিছু না। নীলকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করলাম।

চলবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *