দৃষ্টির বাহিরে

দৃষ্টির বাহিরে !! Part-02

আমি ডায়রিটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে নিলাম।
নীল আমাকে দেখে খুব রেগে গেলো। কিরে এতোক্ষন ধরে কি করছিস তুই?

কিছু না! আমি তো তোমার শার্ট বের করছিলাম।

কিছু না করলে তোর শার্ট বের করা হয়নি কেনো এখনো? তাড়াতাড়ি বের করে নিয়ে যা।

জ্বী যাচ্ছি!

আমি নিজের সাথে করে ডায়রিটা লুকিয়ে নিয়ে আছি। তারপর সেটা স্টোররুমে লুকিয়ে রেখে কাপড় কাঁচতে যাই। কারন আমার রুমে লুকিয়ে রাখতে পারব না। যদি নীল দেখে তাহলে অনেক ঝামেলা হবে।
কাপড় কাঁচার সময় কেটে যাওয়া যায়গায় খুব ব্যাথা করছিলো। কিন্তু কিছু করার নেই আমার। কোনো মতে কাপড়গুলো কেচে রান্না করে রুমে আসলাম। হঠাৎ নীল আবার চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো!

জয়া! কোথায় তুই?

জ্বী বলো, কি হয়েছে?

এভাবে কেউ কাপড় কাচে? ময়লা তো পরিষ্কারই হয়নি।

আসলে আমার খুব টান ধরছিলো পেটের কাটা জায়গায়! কাঁচতে পারছিলাম না তাই আর কি।

তাই জন্যে তুই আমার জামা কাপড় ভালো করে কাচিস নি?

না নীল, আমি ভালো করেই কেঁচেছিলাম।

তুই আমার মুখের ওপর কথা বললি কেন? তোর খাওয়া দাওয়া বন্ধ!
শুধু খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেই ও থামলো না আমাকে টানতে টানতে স্টোর রুমে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখলো।

নীল আমার কথা শুনো!

নীল আমার কথা শুনলো না।
আমি স্টোর রুমে বসে কাঁদতে লাগলাম! হঠাৎ আমার নীলের ডায়রির কথা মনে পড়লো! আমি ডায়রিটা তো এখানেই লুকিয়ে রেখেছিলাম। ডায়রিটা খুঁজতে শুরু করলাম আর পেয়েও গেলাম।
ডায়রিটার প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে বুঝলাম এটা নীলেরই ডায়রি!
ডায়রিটা পড়তে শুরু করলাম।

“আমি নীল। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে, ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছি সব পেয়েছি। ছোটবেলা থেকে বাবা আমার সব আবদার পূরন করতেন।

যখন কলেজে পড়ি তখন আমি ছিলাম কলেজের সবথেকে হ্যান্ডসাম বয়। মেয়েরা আমার সাথে প্রেম করার জন্যে পাগল ছিলো। আমিও সব সুন্দরী মেয়েদের সাথে প্রেম করতাম। কলেজের কোনো সুন্দরী মেয়ে আসলেই তার সাথে প্রেম করতাম। বাবা-মা আমাকে কিছু বলতো না।

তারপর আস্তে আস্তে ভার্সিটিতে উঠি। দেখতে সুন্দর আর আমার বাবার টাকার জন্যে কোনো না কোনো মেয়ে প্রেমে পড়েই যায়।

আমি যখন অনার্স ৩য় বর্ষে পড়তাম তখন আমি প্রথম ইরফানিকে দেখি। ও তখন নতুন ভর্তি হয় আমাদের ভার্সিটিতে। মেয়েটা বড়লোক বাবার মেয়ে, মর্ডান, সুন্দরী। তাই ইরফানিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করে।
ইরফানি আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলো। আমি এর আগে যত মেয়ের সাথে টাইমপাস করিনা কেন! কিন্তু ইরফানির সাথে টাইমপাস করার কথা কখনো মাথাতেই আসেনি। কারনটা ছিলো ও সবার থেকে অন্যরকম।
আমি ইরফানিকে পাওয়ার জন্যে সবকিছু করতে পারি। ইরফানিকে কোনো ছেলে প্রোপোজ করলে তাকে প্রচুর মারতাম! ইরফানিকে ইমপ্রেস করার জন্যে ওর বাসার সামনে বসে থাকতাম! আস্তে আস্তে ইরফানিও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে।
আর তাছাড়াও আমার বাবার অনেক টাকা, তাই ইরফানিও আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করে না।

ব্যাপারটা আমার বাসায় জানাজানি হয়ে যায়, যেহেতু ইরফানির বাবা অনেক বড়লোক আর ইরফানি দেখতেও সুন্দর সেহেতু আমার বাবা আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি করে না। আমি যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে তখন ইরফানির কাজিনের বিয়ের জন্যে দেশের বাহিরে চলে যায়। তারপর আমি….”

হঠাৎ কার যেন দরজা খোলার শব্দ পেলাম! মনে হয় নীল দরজা খুলছে! আমি ডায়রিটা লুকিয়ে ফেললাম। আমার ডায়রির বাকি অংশটা পড়া হলো না। আমি ঘুমানোর অভিনয় করলাম।

ভেবেছিলাম হয়ত আমি না খেয়ে আছি জন্যে নীল আমাকে ডাকতে এসেছে। কিন্তু না! ও আমাকে রাতের খাবার রান্না করার জন্যে ডাকতে এসেছে!

আমি উঠে রান্না ঘরে গেলাম। না খেয়ে থাকার জন্যে মাথাটা প্রচুর ঘুরছিলো!

নীল এসে বলল, দুপুরের খাবার খেয়ে নে যা। তাই বলে ভাবিস না আমি তোকে ভালোবাসি, না খেলে তো তুই এখন ঢং করে পরে থাকবি, আর রান্না টাও করবি না, তাই চুপচাপ খেয়ে এসে রান্না কর।

আমি খাবার খেতে গেলাম কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও জোর করে একটু খেলাম।

তারপর রান্না ঘরে গেলাম রান্না করার জন্যে!
আমার বারবার ইরফানির কথা মনে পড়ছে।

তবে কি ইরফানির জন্যে নীল আমাকে মেনে নিতে পারছেনা? কিন্তু নীল তো আমাকে ডিভর্স দিলেই পারে! ও আমাকে ডিভর্স কেন দিচ্ছে না?

আমাদের বিয়ের পর কি হয়েছিলো?

আচ্ছা ইরফানি এখন কোথায়? ইরফানি কি দেশে ফিরেছে? নাকি ফিরেনি? ইরফানি কি জানে আমার আর নীলের বিয়ে হয়েছে? নাকি জানে না। যদি ও জানে তাহলে ও কি করবে? আমার মনে অনেক প্রশ্ন! কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তরকারিটা পুরে গেছে খেয়াল করিনি।

নীল পাশের রুম থেকে গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছে! তরকারিটা পুড়লো কিভাবে?

আসলে আমি!

তুই কি? কার কথা ভাবছিলি তুই? এই পুড়া তরকারি এখন কে খাবে?
তুই খাবি?

আমি বুঝতে পারিনি নীল!

কি বুঝতে পারিস নি? তুই সব ইচ্ছে করেই করেছিস! কথাটা বলেই আমার হাতে গরম তরকারিতে চেপে ধরলো! আমি ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলাম।

আর কোনোদিন এরকম করবি?

না! করবো না। প্লীজ আমার হাতটা ছাড়ো। আমার খুব জ্বলছে।

নীল আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।
আমি হাতে ঔষধ লাগিয়ে আবার রান্না করলাম। খুব জ্বলছিলো আমার হাতটা।

আমি নিরবে কাঁদছিলাম। আমার বাবা-মার যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে কি তাদের একবারো জানতে ইচ্ছে করতো না আমি কেমন আছি? কোথায় আছি? বেঁচে আছি নাকি মারা গেছি!

তারা যদি জানেন আমি এত কষ্টে আছি তাহলে তারা কি করতেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে!
কিন্তু জেনেই বা কি লাভ, তারা তো কেউ বেঁচে নেই। আমি তাদের শেষ দেখাটাও দেখতে পাইনি। এর থেকে কষ্টের কি হতে পারে?

আমি যদি নীলকে ডিভর্স দিয়ে দেই আমি কোথায় যাবো? জানিনা কিন্তু দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝে থাকা উচিত না।

তাই আমি নীল আর ইরফানির দেখা করাবো। ওদের মধ্যের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দিবো।
আমার জন্যে নীল যা যা হারিয়েছে তার সবকিছু ওকে ফিরিয়ে দেব।
অন্তত নীলের আমার ওপর থেকে রাগটা তো একটু কমবে!

নীল অফিসে গেছে! আমি বাসায় একা একা বসে আছি! আমার বারবার ইরফানির কথা মনে পড়ছে!
নীল তো আমাকে ভালোবাসে না ইরফানিকে ভালোবাসে তাহলে আমি কেন ওর সাথে আছি?
এই এক কথা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।

আচ্ছা আমি যদি নীলের হারিয়ে যাওয়া সবকিছু ফিরিয়ে দেই তাহলে কি ও আমাকে এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিবে? তাহলে কি আমাকে ও আর ঘৃণা করবে না?
হয়তবা!
আমাকে ইরফানিকে খুঁজে বের করে নীলের সাথে দেখা করাতে হবে!কিন্তু কোথায় খুঁজবো ওকে? নীলের ভার্সিটি থেকে কিছু জানা যেতে পারে!

আমি আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইরফানি খুঁজতে শুরু করলাম। এদিকে আমি ইরফানিকে কখনো দেখিনি! আমি কিভাবে চিনব ইরফানিকে?
আমাকে আগে ইরফানির ছবি জোগার করতে হবে! কিন্তু ছবি কোথায় পাবো?

তারপর মনে হলো ভার্সিটিতে তেই পাওয়া যাবে ইরফানির ছবি আর ঠিকানা!

ভার্সিটি গিয়ে ইরফানির একটা ছবি আর একটা ঠিকানা পেলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছু পেলাম না।
তারপর মনে হলো, ইরফানির নিশ্চই ফেসবুক একাউন্ট থাকবে, নীলের ডায়রির বর্ণনা মতে ইরফানি তো খুব আধুনিকা ছিলো তাহলে অবশ্যই ওর ফেসবুক আইডি থাকবে!

আমি বাসায় এসে ল্যাপটপে নিজের আইডিতে লগ ইন করলাম।
তারপর ইরফানির নামটা লিখে সার্চ দিলাম কিন্তু কাউকে পেলাম না।
তারপর মনে পড়লো ওর ডাক নাম ইরফানি কিন্তু ওর ভালো নাম টা হলো সুমাইয়া সিদ্দিকা। এবার এই নামে সার্চ দিলাম! যাক এবার আর নিরাশ হতে হলো না!
আমি ইরফানির ফেসবুক আইডি পেয়ে গেছি।

আমি ইরফানিকে মেসেজ রিকুয়েস্ট দিলাম,

“আসসালামু আলাইকুম। আমি জয়া, নীলের স্ত্রী। আপনার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে। দয়া করে ফ্রি থাকলে আমার মেসেজের রিপ্লাই দিয়েন।”

১৫দিন কেটে গেলো ইরফানি মেসেজ টা সিনও করেনি, আর রিপ্লাইও আসে নি! আমি হতাশ হয়ে পড়লাম!

চলবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *