তোমার আঁচলের উঠোনে

তোমার আঁচলের উঠোনে !! Part- 11

রুশা বিভাবরীকে বেডে বসিয়ে দিয়ে বললো,
— তোমার কি হয়েছে বলো তো? হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে।
— তেমন কিছু না। মাথাটা কেমন ঘুরছিল।
রুশা তার পাশে বসে কাঁদকাঁদ চেহারা বানিয়ে বললো,
— বিভু, তুমি তো অসুস্থ। এখন আমার কি হবে?
— তোমার কি হবে মানে?
— ওরা চলে এসেছে। আর আমি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি। তুমি আমার সাথে যাবে, প্লিজ!
বিভাবরী অবাক হয়ে ভাবে, দুই ভাই-বোনের কত্ত তফাত! একজন জল, তো আরেকজন তেল। মেয়েটা কি পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে, তা তার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আগ্রহ, উত্তেজনায় তার চোখ দুটো ঝকঝক করছে। বিভাবরীর ইচ্ছে করছে না মেয়েটাকে রিফিউজ করতে। সে নিজেকে নর্মাল করার চেষ্টা করে। লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,
— তুমি যাও। আমি আসছি।
প্রত্যুত্তরে রুশা মুচকি হাসে। বিভাবরীর দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বলে,
— তুমি যাবে?
— হুঁ!
বিভাবরী ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে আয়নায় তাকায়। ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই কান্না চলে আসে তার। কি অস্বস্তিকর অনুভূতি! এর জন্য সে ছেলেটাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিবে। খুবই ভয়ঙ্কর!
বিভাবরী কাপড় পাল্টে নেয়। এখন আর ভালো লাগছে না এসব। নিচে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির কাছে আসতেই থমকে যায় সে। এতদিন পর গম্ভীর চেহারার ছেলেটাকে দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে। ছেলেটা কি আগের মতোই আছে? মনে হচ্ছে, না। সে আগের থেকেও ফর্সা হয়েছে। চশমার আড়ালেও চোখ দুটো স্পষ্ট হয়ে আছে..
রুশার “ও” কি তাহলে ধ্রুব? ধ্রুবর বাবা-মা আসেনি কেন? তারা কি ধ্রুবর উপর রাগ করে আছেন? বিভাবরী উল্টো দিকে পা বাড়ায়। আবার ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার নেই।
—————————————-

বিভাবরী ভার্সিটি যাচ্ছে না দুদিন ধরে। নিজেকে সময় দেওয়া প্রয়োজন তার। অন্য কারোর জন্য আর ভাববে না সে। গোল্লায় যাক দুনিয়া। সে আর পেছন ফিরে তাকাবে না।
রিশাদকেও একটা চরম শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তার জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগের দরকার। বাড়ি ফেরার আগেই করতে হবে, যা করার। বাবার সাথে তার কথা হয়েছে। তিনি খুব দ্রুত এখান থেকে তাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছেন।
পাক্কা দুইদিন পর ভার্সিটি যাবার জন্য সে বের হয়। গিয়ে দেখে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। দেরি হওয়ার কারণ রিশাদ। রিশাদ বের হওয়ার পর সে বের হয়। যাতে করে তার সাথে আর দেখা না হয়। ছেলেটার জন্য ক্লাস মিস হয়ে গেল। এখন সময় কাটানোর জন্য লাইব্রেরিতে বসে বই পড়া যায়।

বিভাবরী বই হাতে নিয়ে বসে আছে। পড়ায় মন বসাতে পারছে না সে। অস্থির বোধ করছে। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলো, সবাই লাইব্রেরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে লাইব্রেরি খালি। ব্যাপারটা বোঝার জন্য তাকেও জায়গাটা ছাড়া দরকার। সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানোর আগেই পরিচিত একটা গলার স্বর তার কানে ভেসে আছে। রিশাদ থমথমে গলায় বলে,
— চুপচাপ এখানে বসো, কেশবতী। তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।
বিভাবরী না শোনার ভান করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যায়। কিন্তু তার আগেই রিশাদ পেছন থেকে চেয়ারসহ তাকে আটকে দেয়।
বিভাবরীর কানের কাছে গরম নিঃশ্বাস পড়তেই, তার শরীরের পশম গুলো দাঁড়াতে শুরু করে। তার উপর রিশাদ ফিসফিস করে বললো,
— ভেবো না তোমাকে সরি বলতে এসেছি। আমি শুধু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই।
বিভাবরী ভাঙা গলায় জবাব দেয়,
— আপনি ভাবলেন কি করে আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো!
— এতে ভাবাভাবির কিছু নেই। ঝটপট প্রশ্ন করবো, তুমি চটপট উত্তর দেবো। বুঝেছো??
কথাটা বলে রিশাদ চেয়ার ছেড়ে দেয়। বিভাবরীর সামনাসামনি অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসে। বিভাবরীর হাত থেকে বইটা নিয়ে টেবিলে রেখে দেয়। তারপর গম্ভীর সুরে বলে,
— তোমার প্রথম প্রশ্ন হলো, তুমি কি আমায় ইগ্নোর করার চেষ্টা করছো?
— সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?
— প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা আমি পছন্দ করি না। প্রথমবার বলে মাফ করলাম।
বিভাবরী অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ছেলেটা নিজেকে কি মনে করছে? আশ্চর্য! বিভাবরী তাকে কেন উত্তর দেবে? কে এই ছেলেটা? কিসের অধিকার দেখাচ্ছে সে?
— শুনো বিভাবরী! এখন বলো না যে, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নও। তুমি জানো, তুমি কেন আমাকে উত্তর দিতে বাধ্য। তাই না?
— এটাই তো বলবেন, ভালোবাসেন আমাকে। কিন্তু আমি..
— তোমার ভালোবাসতে হবে না। আমাদের দুজনের জন্য আমার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট।
বিভাবরী উঠে দাঁড়ায়। রাগে শরীর কাঁপছে তার। দাঁত কটমট করে সে বলে,
— আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম মানুষ!
রিশাদ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়,
— থ্যাংক্স ফর কমপ্লিমেন্ট! বায় দ্য ওয়ে, তুমি দাঁড়িয়েছো কেন? বসো। আমার কথা শেষ হয়নি এখনো।
বিভাবরী টেবিল থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। সে এক মুহুর্তের জন্যও এই ছেলেটার সামনে থাকতে চায় না। পেছন থেকে হাতে টান পড়তেই সে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দেয়। চলে যাওয়ার আগে লাইব্রেরির দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। বাইরে থেকে ছিটকিনি টা আটকে মনে মনে বলে,
— আই উইশ, এই দরজাটা যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ যেন দরজা খুলতে না পারে। অসভ্য ছেলেটা কে যেন তেলাপোকা, ইঁদুর, উইপোকা তে খায়। খাড়া খাড়া চুলগুলোতে যেন এসব পোকামাকড় রা পায়খানা করে হলুদ করে দেয়।
কথাটা বলে দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে যায় সে। যদি দরজা ভেদ করে ভেতরের ছবি দেখা যেত তাহলে হয়তো সে দেখতে পেত, ভেতরের মানুষ টা কেমন অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। তার কপালের রগ গুলো কেমন ফুলে উঠেছে…

বিভাবরী বাকি ক্লাস গুলো বেশ খুশি মনেই করে। খুব ভালো মনোযোগও দিয়েছে। দুই দিনের পড়াগুলোও কভার করে ফেলেছে।
ক্লাস শেষে রিক্সার জন্য দাঁড়াতে গিয়েই তার মেজাজ ফের গরম হয়ে গেছে। একটা রিক্সাও পাচ্ছে না কেন? ঘড়িতে সময়টা দেখে আশেপাশে তাকাতেই গলা শুকিয়ে গেছে তার। রিশাদ এমন ভয়ঙ্কর চেহারা বানিয়ে এদিকে আসছে কেন?
হুট করে একটা রিক্সা দেখেই বিভাবরী তাতে চেপে বসে। রিক্সাওয়ালা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে সে যাবে না। তবুও বিভাবরী তাতে বসে আছে। রিক্সাওয়ালা বিরক্ত হয়ে রিক্সা টান দিতেই পেছন থেকে ধরাম করে একটা শব্দ হয়। উনি তাকিয়ে দেখেন, বিভাবরী মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার হ্যান্ডব্যাগ একটা ছেলের হাতে।
ছেলেটা রিশাদ। বিভাবরী পড়ে গিয়ে হাটু ছিলে ফেলেছ, হাত টাও খানিকটা কেটে গেছে। তার ইচ্ছে করছে, ছেলেটাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে দাঁতগুলো ফেলে দিতে। রিক্সা টান দিতেই রিশাদ পেছন থেকে তার ব্যাগ ধরে টান দেয়। যার কারনে বিভাবরী টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়।
বিভাবরী রাস্তা থেকে উঠে রিশাদের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে নির্বিকার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। বিভাবরী কোনো কথা না বলে তার হাত থেকে ব্যাগ আনতে গেলেই সে হাত উপরে উঠিয়ে নেয়। বিভাবরী শান্ত সুরে বলে,
— ব্যাগ দিন আমার।
রিশাদের ভাবান্তর না দেখে সে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
— ব্যাগ দিতে বলেছি আমার।
— চিৎকার করবে না। এটা পাবলিক প্লেস।
বিভাবরী উত্তর শুনে আরও বেশি রেগে যায়। চিৎকার করে বলে,
— আমি পাবলিক প্লেসে অসভ্যতামো করবেন। আর আমি ছেড়ে দেবো? ভেবেছেন টা কি আপনি??

বিভাবরীর চিৎকারে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলে,
— কি হয়েছে ম্যাডাম? উনি কি আপনাকে ডিস্টার্ব করছেন??
বিভাবরী উত্তর না দিয়ে রিশাদের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসে। রিশাদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে চলে আসে সেখান থেকে। কিন্তু রিশাদ সেখান থেকে আসতে পারছে না। তার চারদিকে জটলা বেঁধে লোকজন দাঁড়িয়ে তাকে নানান ধরনের কথা বলছে।

বিভাবরী বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দেয়। এক ঘুমেই দিন কাবার। তার ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক দেখে সে বেশ অবাক হয়। সব কিছু বোঝার জন্য সে নিচে নামে। নিচে নেমে বুঝতে পারে, আসলে পরিবেশ স্বাভাবিক না। রিশাদের বাবা মাথায় আইস প্যাক লাগিয়ে বসে আছেন। তার মা সোফায় বসে নাকের পানি চোখের পানি এক করছেন। মানুষগুলোর জন্য তার বড্ড মায়া হচ্ছে। ভাবতেই কেমন জানি লাগে, এমন অসভ্য ছেলে তাদের সন্তান!
রুশা হুট করে দৌড়ে এসে বিভাবরী কে বলে,
— জানো, বিভু! রিশাদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
বলেই সে হো হো করে হাসতে লাগে। হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে খুব গম্ভীর একটা মেয়ে। গম্ভীর মানুষেরা খুব কম হাসে। আর যখন হাসে তখন দুনিয়া কাঁপিয়ে ফেলে। রুশার অবস্থা ঠিক সেরকম মনে হচ্ছে।

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *