তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 72

এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি আর জেনি। সবকিছুই গোলকধাঁধার মতো লাগছে তাদের। কোনদিকে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অবশেষে একটি গাড়ি ভাড়া করে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছালো তারা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো খেতে গিয়ে। কোন খাবার কেমন হবে জানা নেই তাদের। বাঙালী খাবার টেস্ট করতে গিয়ে খাবারের চেয়ে পানি খেয়েই মন ভরাতে হয়েছে তাদের। হ্যারি মিনিটে মিনিটে শুধু একটা কথায় বলে চলেছে,
— এই দেশের মানুষ এতো ঝাল কি করে খায়? টেরিবল।

সেদিন আর বের হয় নি ওরা। এতোদূর জার্নি আর রাস্তায় ২/৩ ঘন্টার জ্যামে সিদ্ধ হয়েই যায় যায় অবস্থা তাদের। রাতে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে পরের দিন, ১২ এপ্রিল সকাল ১১ টার দিকে শুভ্রকে খোঁজার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো তারা। তাদের কাছে না আছে ছবি না আছে কোনো পরিচয়। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা নাম, “আবরার আহমেদ শুভ্র”৷ একটা নামকে পুঁজি করে কি একটা মানুষকে খুঁজে বের করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব, হয়তো নয়। তবে চেষ্টা করতে দোষ কি?ঢাকায় সরকারী বেসরকারি মিলে মোট ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এতো বাজে ভাবে জ্যামে আটকে থেকে ২৫ টি ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নেওয়া তাদের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভবের পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। তারউপর সবকিছুই তাদের অপরিচিত। প্রথমদিনে কোনোরকম দুটি ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতেই প্রায় রাত নেমে এলো। আমেরিকায় বসে বসে ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলো ক্রমেই তা সাপের পা দেখার মতো অসম্ভব হয়ে উঠলো। রাত কাটিয়ে ভোর হলে আবারও বেরিয়ে পড়লো ওরা। ঢাকা শহরের মাঝেই তিনটি ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে একটি শুভ্র খোঁজে পেলো তারা। খুশিতে লাফিয়ে উঠেও মুহূর্তেই খুশিটা মাটি হয়ে গেলো তাদের যখন শুনলো লোকটির নাম আবরার আহমেদ নয় আরিফুল রহমান শুভ্র। জেনির সেই মুহূর্তে লোকটির চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। ব্যাটা,দুনিয়াতে কি আর কোনো নাম ছিলো না? শুভ্র নামটাই রাখতে হলো? সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার দিকে ঢাকার একটি পার্কের কাছে গিয়ে বসলো ওরা। তখনই বেশ অদ্ভুত একটি জিনিস চোখে পড়লো। কিছু ছেলেমেয়ে দল বেঁধে রঙের কৌটো হাতে রাস্তায় পেইন্ট করছে। হ্যারি অবাক হয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে উঠলো,
— জেনি? কি করছে ওরা? রাস্তাস পেইন্ট করছে কেন?
জেনির নিজেরও তেমন একটা ধারনা ছিলো না। তাই সামনে এগিয়ে একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— এক্সকিউজ মি?
ছেলেটি ফিরে তাকিয়ে বললো,
— জি বলুন।
— আচ্ছা, রাস্তায় এভাবে রঙ করা হচ্ছে কেনো?
— ফরেনার?
— ইয়াহ।

— ওহ,ওয়েলকাম টু আওয়ার কান্ট্রি। কাল পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ…
জেনি হেসে বললো,
— আমি বুঝতে পেরেছি। বাংলা বছরের প্রথম দিন তাই তো?
ছেলেটি হাসলো। বললো,
— হ্যাঁ। কাল সারা দেশজুড়েই উৎসব। আপনারাও এড হতে পারেন। এই দিনে প্রায় সব মেয়েরাই শাড়ি পড়ে আর ছেলেরা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া। আপনারা চাইলে ট্রাই করতে পারেন। ভালো লাগবে। রমনায় বিরাট মেলা হবে কাল।
জেনি ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে এলো।
হ্যারিকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে উঠে পড়লো ওরা। কাল পহেলা বৈশাখ,সরকারি ছুটি। অর্থাৎ, কাল কোনো ভার্সিটিই খোলা থাকবে না। সারাটা দিন ফাঁকা যাওয়ার থেকে নিজেকে বাঙালীদের মতো শাড়িতে মোড়ালে কেমন হয়? জেনি মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে শাড়ি পড়বে। হ্যারিকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে জোড় করেই নিজের জন্য শাড়ি আর হ্যারির জন্য লাল পাঞ্জাবি কিনে নিলো সে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো পরের দিন সকালে। কিছুতেই শাড়ি পড়তে পারছে না জেনি, এখন উপায়? নিজে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হ্যারিকে ডাকলো সে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। উল্টো ঝামেলা আরো বেড়ে গেলো। অবশেষে হোটেলের একজন মেয়ে কর্মচারীকে ম্যানেজ করে শাড়ি পড়তে হলো জেনির। হোটেল থেকে বেরিয়ে রিক্সা নিলো জেনি। “রিক্সা” নামক জিনিসটা তাদের দু’জনের জন্যই একদম নতুন। তবুও এই ভয়ানক জিনিসে চেপেই মেলা পর্যন্ত পৌঁছালো ওরা। রমনায় গিয়ে তাদের বিস্ময় যেন আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো। এতো মানুষ আর এতো রঙ-বেরঙের সাজ! চারদিকটা যেন বাহিরী রঙের মেলা। মেলাটা কিছুক্ষণ ঘুরে দেখার পরই বিস্ময়কর এক কান্ড ঘটলো। হাজারো বাঙালীর ভীরে কেউ একজন হ্যারির নাম ধরে ডাকলো। এমন একটা জায়গায় নিজের নাম শুনে অনেকটায় চমকে গিয়েছিলো হ্যারি। নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়েই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। লাল-সাদা পাঞ্জাবী গায়ে একটি ছেলে এগিয়ে এসে বললো,
— হ্যারি? তুমি এখানে?
— হেই অ্যাশ! কেমন আছো তুমি?
ছেলেটি হাসলো। জেনি ওদের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। চারপাশে তাকিয়ে মানুষজন দেখছে সে। এতো এতো মানুষের মাঝেও একজায়গায় চোখ আটকে গেলো তার। ওর থেকে এক/দুই হাত দূরে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো রঙের ধুতি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। কোলে দেড়-দুই বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির গায়ে লাল রঙের ফ্রক। সিল্কিচুলগুলো দুপাশে ঝুঁটি করা। সামনের কিছু চুল এসে পড়েছে কপালে। চেহারাটা বাবার মতো হলেও গায়ের রঙটা উজ্জল শ্যামা। বড় বড় চোখদুটো ঘন পল্লবে ঢাকা। হাতে একটি চিপসের প্যাকেট। ছেলেটি বাচ্চার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতেই হাতের চিপসটা বাবার হাতে দিয়ে সে ও ঠিক একই কাজ করলো। বাবার কপালে পড়ে থাকা সিল্কচুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিলো। মেয়ের কাজ দেখে হেসে উঠলো ছেলেটি। সাথে সাথেই যেন চমকে উঠলো জেনি। রোদ তার ডায়েরিতে যেভাবে বর্ননা করেছিলো ছেলেটির হাসিটা ঠিক সেই রকম। তেমনি বাঁকা দাঁত আর থুতনিতে সেই কালো তিল। জেনি আরো একপা এগিয়ে এসে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। ঠিক তখনই একটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের পাশে। মেয়েটি মোটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়েছে। মেয়েটার শাড়ি পড়ার ধরনটা অন্যরকম। জেনির মতো কুঁচি দিয়ে শাড়ি পড়ে নি সে। পিঠে পড়ে আছে একরাশ লম্বা চুল। তাতে গাঁথা তিনটি লাল গোলাপ। মেয়েটির গাঢ় কাজল চোখ আর পাতলা ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টক মুখে একটা প্রতীমা প্রতীমা ভাব এনে দিয়েছে যেন। একদম স্বচ্ছ, শীতল রূপ। মেয়েটি পাশে দাঁড়াতেই বাচ্চা এবং বাবা দু’জনের মাঝেই অদ্ভুত প্রাণোচ্ছলতা খেলে গেলো। ছেলেটি পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির কানের পাশে চুল গুঁজে দিয়ে কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে মুচকি হেসে বললো,
— একদম রসগোল্লা লাগছে।
বাচ্চাটি কিছুক্ষণ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থেকে বাবার মতোই তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে কানে চুল গুঁজে দিয়ে টুপ করে চুমু দিয়ে দিলো কপালে। বাবাকে কপি করে বললো,
— এয়দম অসগোল্লা লাগচে।
বিস্মিত বাবা-মা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেই হেসে উঠলো। বাচ্চাটিও খিলখিল করে হেসে উঠলো। কি অদ্ভুত! চেহারাটা বাবার মতো হলেও হাসলে কোথাও যেন একদমই মায়ের মতো লাগে তাকে। সৃষ্টিকর্তা কি অদৃশ্য ধাঁধা তৈরি করে দিয়েছেন চারপাশে। ওদের কান্ড দেখে একা দাঁড়িয়েই খিলখিল করে হাসছিলো জেনি। হঠাৎ করে পেছন থেকে ডেকে উঠলো হ্যারি,
— জেনি? একা একা হাসছো কেন?
জেনি হাসিমুখেই বললো,
— নাথিং।
হ্যারি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর পাশের ছেলেটিকে ইশারা করে বললো,
— জেনি? ইনি হচ্ছেন অ্যাশ। আমার বড় ভাইয়ের ফ্রেন্ড। ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছুদিন একসাথেই পড়াশোনা করেছেন উনারা।৷আর অ্যাশ? ও হচ্ছে জেনি, আমার বাগদত্তা।
জেনি হালকা হেসে স্পষ্ট বাংলায় বললো,
— হ্যালো ভাইয়া।
ছেলেটি বিস্মিত কন্ঠে বললো,
—- আপনি বাংলা জানেন?
জেনি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো কেউ,
— ওই সাহেল? আদ্র-রোদ্র কই? দেখছিস ওদের?
জেনি চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখলো সেই সাদা পাঞ্জাবি পড়নে ছেলেটাই কথা বলে চলেছে। ততোক্ষণে হ্যারিও ভ্রু কুঁচকে এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করে দিয়েছে। “সাহেল” নামটা কেমন পরিচিত লাগছে তার। কিন্তু তাদের আরো কিছুটা চমকে দিয়ে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
— শুভ্রতাকে নিয়ে ফার্স্ট স্টলটাতে ঢুকে যা। ওখানেই লাঞ্চ করবো সবাই। ভেতরে নাবিলা,রুহান, সাব্বির সবাই আছে। বাচ্চারাও আছে।
জেনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। “শুভ্রতা” আর “শুভ্র” কাছাকাছি। তবে কি? জেনির ভাবনার মাঝেই হাত বাড়ালো সাহেল। হাসিমুখে বললো,
— হ্যালো,আমি আশরাফ আল সাহেল। হ্যারির জন্য নামটা একটু কঠিন বলে ও আমাকে অ্যাশ বলে ডাকে। বাট আপনার জন্য কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে না।
জেনি টোটালি শকড হয়ে তাকিয়ে আছে। কয়েকসেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— হাই! আমি জেনিফা কিংস্টোন।আচ্ছা? একটু আগে যে আপনার সাথে কথা বললেন, উনি কে? না মানে,পরিচিত লাগছিলো খুব।
সাহেল স্বাভাবিক গলায় বললো,,
— ও আমার ফ্রেন্ড। ওর নাম শুভ্র।আপনার সাথে কোথায় দেখা হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছি না।

জেনি হাসলো,
— হয়তো অন্যকেউ হবে। দুজনের মাঝে গুলিয়ে ফেলিছি আমি। এনিওয়ে,, আপনারা বোধহয় এখন লাঞ্চ করবেন। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ট আমরা দু’জন কি আপনাদের সাথে জয়েন হতে পারি?
— ইয়াহ, অফ কোরস্। আমি এখনই রিকুয়েস্ট করতাম আপনাদের। প্লিজ আসুন। আপনারা দু’জন জয়েন করলে আরো খুশি হবো আমরা। বিশেষ করে বাচ্চারা…প্লিজ কাম।
খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে জেনির। অবশেষে শুভ্রকে খুঁজে পেয়ে গেছে সে এতো সহজে খুঁজে পাবে ভাবতেই পারে নি জেনি। আচ্ছা? শুভ্রকে তো পেলো। তাহলে রোদ কোথায়? ওই মেয়েটাই কি রোদ?বাঁচে আছে? নাকি মারা গেছে? নাকি অন্যকাউকে বিয়ে করে নিয়েছে শুভ্র??
#চলবে,