তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 69

নানুর মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো আজ। আজ প্রথম মামুর উপস্থিতিতে নানুর মৃত্যুবার্ষিকীর কার্যক্রমগুলো পুরো করা হলো। সেই উদ্দেশ্যেই সবাই মিলে গ্রামে গিয়েছিলাম আজ। বাবার কথা মনে পড়েই আবেগাপ্লুত হয়ে মামু থেকে গেছেন নানুর সেই নির্জন বাড়িটিতে। সাথে থেকে গেছেন মামানি, মা- বাবা। তারা নাকি আলাদা সময় কাটাতে চায় তাই আমাদের ফিরে আসা। প্রথম গাড়িটিতে অভ্র ভাইয়া, আপু, আদ্র -রোদ্র, সাহেল ভাইয়া, নাবিলা আপু আর সাদাফ বসেছে। আদ্র রোদ্র বেশ বড় হয়ে গেছে এখন। কিছু ধরে ঝটপট দাঁড়িয়ে পড়তে পারে তারা। দুটো দাঁতও দেখা দিয়েছে মুখে। সাদাফ অর্থাৎ সাহেল ভাইয়ার ছেলের এখন তিনমাস চলছে। এই পিচ্চি বয়সেই ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। হয়তো বড় হয়ে বেশ গম্ভীর টাইপ ছেলে হবে। আমি আর শুভ্র পরের গাড়িটিতে বসেছি। শুভ্র ড্রাইভ করছে আর আমি তার পাশে। ভাইয়া অফিস থেকে সরাসরি বাইক দিয়ে চলে এসেছিলো বলে আমাদের পেছনে বাইক করেই আসছে। সব ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু একটা ধমকা হাওয়ায় মুহূর্তেই পাল্টে গেল সব। শুভ্র আমায় বললো,

— রোদ? কিছু খাবে? পেছনে খাবার রাখা আছে। ওই ব্যাগটাই…
শুভ্র পেছন ফিরে ইশারা করে দেখাতেই কোথা থেকে এক গাড়ি এসে পড়লো ঠিক সামনে। শুভ্র প্রথমে খেয়াল না করায় বিপদটা আরো বেড়ে গেলো আর যতক্ষণে শুভ্র সামনে তাকালো ততক্ষণে শুভ্রর হাতে করার মতো কিছুই ছিলো না। আমি শুধু দেখলাম শুভ্র দ্রুত সিটবেল্ট খুলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর ভয়ঙ্কর এক শব্দ। শব্দের পরই নিস্তব্ধতা… ভয়ানক নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা যেন এক নরকীয় ব্যাথা দিচ্ছিলো আমার। মাথায় চিনচিন ব্যাথা করে উঠতেই চোখ মেলে তাকালাম আমি। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমার চারপাশে।এখানে সেখানে ধোঁয়া উড়ছে। কাঁচের টুকরা আর চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গাড়িটাতে রক্তের ফোঁটা! রক্তরাঙা শুভ্র নিস্তেজভাবে পড়ে আছে আমার উপর। দু’হাতে আমার দু’পাশের সিট আঁকড়ে ধরেছে সে। রক্ত আর প্রিয় মানুষের নিস্তেজ মুখটা দেখেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। আমি জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলে উঠলাম,
— শুভ্র? উঠুন না প্লিজ। খুব ভয় লাগছে আমার। শুভ্র? শুভ্র?
কিন্তু শুভ্র উঠলেন না। আমি এবার চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম তাকে। উনাকে হারানোর ভয়টা রক্তের ভয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিলো তখন। কিছুক্ষণ ডাকার পর বিরবির করে কিছু একটা বললেন উনি। আমি তাড়াতাড়ি উনার মুখের কাছে কান পাততেই কানে এলো,
— লাভ ইউ রোদপাখি। এন্ড…লাভ ইউ মোর মাই প্রিন্সেস।
তারপর আবারও সেই ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা। নিজেকে পাগল পাগল লাগছিলো আমার। পাগলের মতো চিৎকার করছিলাম। ততক্ষণে ভাইয়া, সাহেল ভাইয়া, অভ্র ভাইয়া সবাই ছুটে এসেছে। গাড়ির দরজা ধরে কিছু একটা বলছিলো তারা। কিন্তু কিছুই যেন আমার ব্রেন পর্যন্ত পৌঁছুচ্ছিলো না। কিভাবে কিভাবে হসপিটালে নেওয়া হলো আমাদের। সবটা সময়ই একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি। আমার গায়ে তেমন কোনো আঘাত লাগে নি। শুভ্র উপরে এসে পড়ায় কোনো কিছুই তেমন একটা গায়ে এসে লাগে নি আমার। হসপিটালের করিডোরে চুপচাপ বসে আছি। অপারেশন থিয়েটারের উজ্জ্বল লাইটটি নির্বিকার ভঙ্গিতে জ্বলছে। যেন, আমার কষ্টটাকে চোখ রাঙিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পর একটা নার্স এসে ঝাঁকি দিলো আমায়। আমি তার দিকে ফিরে তাকাতেই বললো,
— ম্যাম? আপনার নাক আর কান দিয়ে অল্প রক্ত আসছে। চলুন ম্যাম ড্রেসিং করে দিই।
আমি আবারও চুপচাপ বসে রইলাম। কারো কথায় মাথা পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে না আমার। নার্সটি আবারও একই কথা বলাতে অটির দিকে ইশারা করে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলাম,
— আমার হাজবেন্ড…

— আপনার হাজবেন্ড ঠিক আছে ম্যাম। প্লিজ চলুন। আপনার চেকাপের প্রয়োজন। নয়তো বেবির ক্ষতি হতে পারে।
নার্সের মুখে “বেবি” কথাটি শুনে নিজের পেটে হাত রেখে তারদিকে তাকালাম আমি। যেন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে একজন ডক্টর এসে জোর করেই নিয়ে গেলেন আমায়। কেবিনে বসে ড্রেসিং করতে করতে জিগ্যেস করলেন ডক্টর,
— কানে বা নাকে কোথাও ব্যাথা লাগছে, ম্যাম?
আমি মাথা নাড়লাম। যার অর্থ,ব্যাথা লাগছে না। ডক্টর মাথা দুলিয়ে চিন্তিত গলায় বললো, “ওকে!” হাতের একজায়গায় কেটে যাওয়ায় সেখানে ব্যান্ডেজ করে কিছু টেস্ট করানোর জন্য নার্সের সাথে পাঠিয়ে দিলেন আমায়। একদিকে শুভ্রর অপারেশন চলছে অন্যদিকে আমি টেস্ট করাতে যাচ্ছি কি একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি আমার। অবশেষে সব টেস্ট শেষ করে অটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে অপারেশন শেষ হয়েছে। অপারেশন সাকসেসফুল, দু- তিনঘন্টার মাঝেই সেন্স ফিরবে তার। মাথায় আর হাতেই সিরিয়াসলি ইনজুর হয়েছেন উনি। কয়েকদিন বেডরেস্ট নিলে একদমই ঠিক হয়ে যাবেন এটাই ডক্টরদের আশা। কথাটা শুনে আবারও সবার মুখে হাসিফুটে উঠলো। আমিও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু এই স্বস্তি যে সাময়িক সেটা জানা ছিলো না তখন। কয়েক মিনিট পর ডক্টরের বলা একটি কথায় পুরো পৃথিবীটাই বদলে গেলো আমার। একজন বয়স্ক ডক্টর আমার কাছে এসে বললেন,
— তোমার গার্ডিয়ান কেউ সাথে নেই মা?
সাথে সাথেই সবাই এগিয়ে এলেন। ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
— ইয়েস ডক্টর। আমি ওর ভাই। এনি প্রবলেম?
ডক্টর ইতস্তত করে বললেন,
— হ্যাঁ বাবা। আমার সাথে এসো।
আমি স্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠলাম,
— পেশেন্ট যেহেতু আমি। আমাকেই বলুন ডক্টর। এন্ড এখানেই বলুন। প্লিজ ডক্টর। আমার জানা উচিত।
ডক্টর আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
— তোমার মাথায় ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে মা। প্রায় তিন জায়গা থেকে ব্লাড লিক হচ্ছে। রক্তের পরিমানও বেশি। এটা বন্ধ করার কোন টেকনিক ডক্টরদের হাতে নেই মা। সমস্যাটা অল্প হলে আমরা কিছু করতে পারতাম কিন্তু তোমায় সমস্যাটা এখন অনেকটাই গম্ভীর আকার ধারন করেছে। তাই…
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
— তাই?
ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— তোমার কাছে আর ৫- ৬ ঘন্টা সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে ব্লাড লিক করা শেষ হবে। তারপর…
আমার হাতটা জোরে চেপে ধরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিগ্যেস করলেন ভাইয়া,
— তারপর?

— তারপর শেষ। লিক হওয়া শেষ হতেই তোমার বোনের জীবনটাও ইতি টানবে বাবা। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই ইয়াং ম্যান। সো সরি!
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে কি সব বুঝিয়ে, চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ডক্টরের কাছে ছুঁটলেন। সাথে গেলেন সাহেল ভাইয়া আর অভ্র ভাইয়া। আপু আর নাবিলা আপু আমার দু’পাশে বসে আছেন। আপুও আমার মতো স্তব্ধ। নাবিলা আপু কিসব বলছেন আর সাদাফ গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলাম। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। জীবনে কতো সময় অযথা নষ্ট করেছি অথচ আজ! বিধাতা সময়ের কাঁটায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আমায়। সে কাঁটায় প্রতিটি সেকেন্ডের শব্দই যন্ত্রণার, কষ্টের আর একরাশ ভয়ের। এভাবে কি বাঁচা যায়? শুভ্রর এতো চেষ্টাও সফল হলো না আজ। আমাকে আগলে রাখার শেষ চেষ্টা করে প্রথম এবং শেষবারের মতো ব্যর্থ হলেন উনি। তার রোদপাখি ৬ ঘন্টা পর আর থাকবে না। এই কথাটা কি মেনে নিতে পারবেন উনি? কি করবেন আমি চলে যাওয়ার পর? আবারও বিয়ে করবেন? নাকি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবেন উনি! কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম দুজনে মিলে। আর দুটো মাস গেলেই কোল জুড়ে আসতো একগুচ্ছ সুখ। সেই সুখটা আর দেখা হলো না। আমার বাচ্চাটা…. বাচ্চার কথা মনে হতেই টনক নড়লো আমার। আমি ৬ ঘন্টা পর না থাকলে আমার সাথে সাথে আমার বাচ্চাটাও। না! এটা হতে দেওয়া যাবে না। ওকে আসতে হবে। আমার ভাগের জীবনটুকুও উপভোগ করতে হবে তাকে। এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখতে হবে। কথায় আছে, সন্তানের বেলায় “মা” নামক মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী নারী হয়ে উঠে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। নিজের দুঃখটুকুকে ছুঁড়ে ফেলে সন্তানকে বাঁচাতে হবে আমায়। আমি তো এমনিও থাকবো না কিন্তু বাচ্চাটাই যে শুভ্রর শেষ ভরসা!
#চলবে…