00

জীবনের গল্প !! Part- 03 (Last-Part)

সেদিনের পর থেকে আমি আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতাম না। তবুও মাঝে মাঝে মনে হতো কোনো একদিন সে আমাকে নিতে আসবে,কোনো একদিন আমার শ্বশুর শাশুড়ি তাদের ছেলের বউয়ের অভাব বোধ করবে। কিন্তু দিনের পর দিন চলে যায় এমন দিন আমার জীবনে আসে না। আমার একাকিত্ব জীবনের প্রতি অনেক বিতৃষ্ণা কাজ করতে থাকে। আমি চাকরির জন্য ঠিকমতো পড়তে পারতাম না আমার বাচ্চাটার জন্য। একসময় বুঝতে পারলাম আমাকে এগিয়ে যেতে হলে কষ্ট সহ্য করতে হবে। আমি আমার ছোট্ট বাচ্চাটাকে বিছানায় শুইয়ে মনের ভিতর হাজারো কষ্ট চেপে রেখে পড়তে বসতাম। যখন দেখতাম বাচ্চাটার কান্না বেড়েই চলেছে তখন আমি পড়া থেকে উঠে তাঁর কাছে চলে যেতাম। তাঁর কান্না থামাতাম।
একসময় বুঝতে পারলাম আমার ভাইয়েরাও কেনো জানি আমাকে আর আমার সন্তানকে নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। বিরক্ত হবারই কথা। কারণ কোনো ভাইওই হয়তো চাইবে না তাঁর বোন তাদের বাসায় সারাজীবন থাকুক। আমার অবস্থাও তেমন। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দিয়েছে,হয়তো আর কখনো আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবে না। মাও কেনো জানি আমার সন্তানটাকে খুব বেশি ভালোবাসতে পারে না। আমার ভাইয়েদের সন্তান নিয়েই সবসময় থাকতে হয় তাকে। আমিও কখনো এটা নিয়ে কিছু বলি না। আর বলবোই বা কি করে? অনেক দিন পর পর যদি বাপের বাড়ি আসতাম তাহলে হয়তো আমার সন্তানের জন্য তাঁর নানা বাড়ির আদরটা আলাদা করে তোলা থাকতো। কিন্তু যেখানে সবসময় নানা বাড়িতেই পড়ে থাকতে হয় সেখানে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
একবছর পরেও আমি ভালে একটা চাকরি পেলাম না। অনেক পড়ালেখা করার পরেও সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণের খুব কাছাকাছি গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে আমাকে। তবুও আমি হতাশ হলাম না। কিন্তু যেদিন মা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল,
“তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছে তোর ভাইয়েরা। কতোদিন আর এভাবে একা একা জীবন কাটাবি বল? তোরও তো জীবন আছে তোরও ভবিষ্যৎ আছে।”
তখন আমি মাকে বললাম,

“আমাকে নিয়ে তোমাদের এতো চিন্তা? আমাকে আর আমার সন্তানকে কী দুবেলা খাবার দিতে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে তোমাদের? তোমাদের তো কোন অভাব নেই। টাকা পয়সা,সম্পত্তি এগুলোতে তো আমারও ভাগ আছে। সেগুলোর বিনিমেয় তো আমাদের দুজনকে তোমাদের কাছে থাকতে দিতে পারো।”
তখন আমার মা বলল,
“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমরা সবাই তোর ভালো চাই। জীবনে টাকা পয়সায় তো সব না। স্বামীর সংসার ছাড়া মেয়েরা অচল। ছেলেটা অনেক ভালো। তুই কথা বলে দ্যাখ তোর ভালো লাগবে।”
তখন আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“ঠিক আছে তোমরা যেহেতু চাইছো বিয়েটা করি তাহলে না করবো না।”
তখন মা বলল,

“একটা সমস্যা আছে। তবে কিছুদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা বলেছি তোর কোনো বাচ্চা কাচ্চা নেই। বিয়ের পর তোর ছেলে আমাদের কাছে থাকবে। আমি জানি একজন মায়ের সন্তানকে ছেড়ে থাকতে অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু এ ছাড়া কি করার আছে বল? তোর সন্তান আছে জানলে এতো ভালো ছেলে তোকে বিয়ে করবে না। তাই এমন বলেছি। দুই এক বছর গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তোর খারাপ চাই না।”
মায়ের কথাগুলো শুনে কেনো জানি চোখের পানিটা ধরে রাখতে পারলাম না। জলভরা চোখেই মাকে বললাম,
“কোনো মা কি তাঁর সন্তানের সাথে এতো বড় অন্যায় করতে পারবে? আমার জন্য আমার সন্তান তাঁর বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন আমিও যদি ওকে রেখে চলে যাই তাহলে কি ওর মন থেকে বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে যাবে না? তোমরা যেমন আমার খারাপ চাইতে পারো না,তাহলে আমি আমার সন্তানের খারাপ চাইবো কি করে? আমাকে বিয়ে করার আগে আমার সন্তানকে মেনে নিতে হবে। যে আমার সন্তানকে মেনে নিবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। তাছাড়া আমাকে বিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করবে না কখনো। আমার সন্তানের জন্য আমি পৃথিবীর সব সুখ বিসর্জন দিতে পারি।”
আমার মা সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে কোনো কথা বলতে পারেনি। কারণ তিনিও একজন মা। তারপরে আমার সন্তান ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। একসময় আমি প্রথমবারের মতো আমার সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনি। সেদিন আমি আমার ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। কারণ যেদিন আমার সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনি সেদিন আমি বেঁচে থাকার মতো কিছু একটা করতে পারি। অনেক কষ্ট সহ্য করার পর আমি চাকরিটা পেয়ে যাই। আমার বাবা মার বাড়িতে কোনো অভাব ছিলো না। তবুও কেনো জানি বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের চাহিদাটা পূরণ করতে পারতাম না। কখনো ইচ্ছে করে কেউ কিছু দিতো না। তারা ভাবতো তিনবেলা খেতে দিচ্ছি,থাকতে দিচ্ছি আর কি চাই? অথচ দুইজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য থাকা খাওয়া বাদে আরও অনেক কিছু লাগতো। আমি সেগুলোর অভাব ভোগ করেছি।
তাই চাকরিতে জয়েন করার পরের দিনই আমি আমার আপনজনদের থেকে দূরে সরে যাই। আমার চাকরিতে জয়েন করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই চাকরি হওয়ার পরেও অনেকদিন বাবা মায়ের কাছে থাকতে হয়েছে। সেজন্য চাকরিতে জয়েন করার আগের দিনই আলাদা একটা বাসা নেই। আমি যখন চাকরিতে জয়েন করি তখন আমার ছেলের বয়স তিন বছর। তিন বছরের একটা ছেলেকে রেখে অফিস করাটা যে কতোটা কষ্টের, কতোটা যন্ত্রণার সেটা শুধু একজন মাই উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। কাজের মেয়ের কাছে রেখে অফিসে চলে যেতাম। এসে যখন কোলে নিতাম তখন ভিতরটা জুড়িয়ে যেতে। এভাবে আরও দুইটা বছর কেটে গেলো। আমার ছেলের বয়স তখন পাঁচ বছর।

আমি বুঝতে পারলাম আমার বেঁচে থাকার জন্য আমার ছেলেটাই যথেষ্ট। আর কাউকে দরকার নাই আমার জীবনে। স্বামী,সংসার,বাবা মা,ভাই কাউকে দরকার নাই। হঠাৎ করে একদিন আদনান বাসায় এসে বসে আছে। আমি তখন অফিসে ছিলাম। বাসায় এসে যখন তাকে দেখলাম তখন খুব বেশি অবাক হলাম না। কারণ আমি অনেক আগেই এই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করা ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে দেখামাত্রই আদনান উঠে দাঁড়ালো।
অনেক কথা হলো তাঁর সাথে। আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেনো সে আমার কাছে আসেনি। সে কোনো উত্তর দিতে পারেনি। বুঝতে পারলাম সে আমাকে আর আমার ছেলেকে নিতে এসেছে। তখন কি বলবো কিছু বুঝতে পারলাম না। নিজের অজান্তেই বললাম।
“তুমি যদি দীর্ঘ পাঁচটা বছর একাকিত্বের স্বাদ নিয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসতে তাহলে আমি তোমাকে গ্রহণ করে নিতাম। কিন্তু তুমি তো তা করোনি। তুমি বিয়ে করেছিলো যদিও আমি জানি না এটা সত্য কিনা। তবে বিয়ে না করলে এভাবে নিজের স্ত্রী সন্তান ছেড়ে পাঁচটা বছর থাকতে পারতে না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি আমার ছেলেকে সবসময় বলে এসেছি তাঁর বাবা নেই। তাঁর বাবাও আমি,মাও আমি। আমি আমার ছেলেকে কখনো মিথ্যা বলতে শিখাইনি। আমি চাই সে যেটা সে জেনে এসেছে সেটাই সত্য হোক।”
আমার কথাগুলো শুনে আদনান আর কিছু বলেনি। আমার ছেলেকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে দুঃখী মনে চলে যায়। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে বলতে। তুমিও থেকে যাও কিন্তু আবার মনে হলো কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখা উচিত। সূর্য যদি তাঁর কথা কোনোদিন না রাখে তাহলে পৃথিবীটা সেদিন কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। আমিও চাই না আমার ছেলে আমাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে জানুক।
সমাপ্ত।

সমাপ্তিটা অন্য ভাবেও হতো পারতো। মেয়েটা পড়ালেখাটা বিসর্জন দিয়ে তাঁর স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারতো। কিংবা তাঁর স্বামী তাকে বুঝিয়ে নিয়ে গিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারতো। একটা সংসার ভাঙন কারো জন্যই সুখ বয়ে আনে না। বিশেষ করে সন্তানের জন্য। প্রতিটি সন্তানই বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা পেতে চায়। কিন্তু এই বিচ্ছেদের কারণে অনেক সন্তান বাবা মায়ের পবিত্র আদর থেকে বঞ্চিত হয়। এর জন্য দায়ী কারা? শুধুই কি বাবা মা নাকি আশেপাশের মানুষও। অনেক সময় অাশেপাশের মানুষের কুযুক্তিতেও ঘর ভাঙে। বিচ্ছেদ হলে আগেই হওয়া উচিত। সন্তান হওয়ার পর যেনো কোনো বাবা মা নিজেদের সংসার না ভাঙে এটাই কাম্য। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও নিজেরা কম্প্রোমাইজ করে একসাথে থাকা উচিত।
এরকম একটা ঘটনা বাস্তবে দেখেছিলাম সেটাকেই গল্পে রুপ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। জানি না কতোটুকু পেরেছি। সর্বোপরি ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।