গল্প ¦ অঙ্ক টিচার— পর্বঃ- ৩
শারমিন আক্তার
–আয়াতঃ তনয়া শোন?
তনয়া তখন কলেজ শেষ করে বাড়ি যাচ্ছিলো। আয়াতের ডাকে পিছনে ফিরলো।
তনয়াঃ আমাকে ডাকেছেন স্যার ?
আয়াতঃ হ্যা! তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে?
তনয়াঃ হ্যা বলুন স্যার?
আয়াতঃ এখানে না। তুমি আজকে আমাদের বাসায় সবার যাবার আধা ঘন্টা আগে যাবে যদি তুমি ফ্রি থাকো?
তনয়াঃ কিন্তু স্যার?
আয়াতঃ ভয় নেই। বাসায় বাবা মা সবাই আছে। বিশ্বাস না হলে আমাদের বাসার টেলিফোনে বা তোমার বাবাকে দিয়ে ফোন করিয়ে কনফ্রম হতে পারো?
তনয়াঃ হালকা হাসি দিয়ে কি যে বলেন স্যার? আমি আপনাকে অনেক বিশ্বাস করি।
আয়াতঃ ধন্যবাদ।
বিকালে কথামত তনয়া অনেক আগে পড়তে গেলো। দড়জায় ডোরবেল বাজালো। দড়জা আয়াতের মা খুললো । তাকে দেখেই তনয়া সালাম দিলেন।
তনয়াঃ আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
আয়াতের মাঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আরে তনয়া তুমি? কেমন আছো?
তনয়াঃ জ্বি আন্টি ভালো। আপনি?
আয়াতের মাঃ খুব ভালো ভিতরে আসো।
তনয়াঃ আন্টি স্যার কোথায়?
আয়াতের মাঃ ও ওর রুমে। তুমি বসো আমি ওকে নিচে পাঠিয়ে দিতেছি।
আয়াত নিচে এসে তুলির পাশে বসলো।
তনয়াঃ স্যার কি যেনো বলতে চাইছিলেন?
আয়াতঃ তনয়া তোমার কি কিছু হয়েছে?
তনয়াঃ নাতো স্যার। কিন্তু কেন?
আয়াতঃ না তুমি সেই আগের তনয়া আর নাই!
তনয়াঃ কেন স্যার আপনার এমন কেন মনে হলো?
আয়াতঃ দু বছর আগে যখন তোমাকে পড়াতাম তখন তোমার মাঝে অন্যরকম একটা চাঞ্চল্য, দূরন্তপনা আর দুষ্টমি ছিলো। কিন্তু এখন সেটা তোমার মাঝে নেই। মনে হচ্ছে তুমি সেই তনয়াকে নিজের ভিতর বন্দি করে উপরে একটা মুখোশ পরে আছো! মনে হচ্ছে নিজেকে লুকাতে চাইছো? কোথাও এটার জন্য আমি দায়ী নইতো?
তনয়াঃ না স্যার সেরকম কিছু না। আপনি প্লি নিজেকে দায়ী করবে না? আর স্যার আপনিতো আমাকে বলেছিলেন ছেলেমানুষি সবসময় চলে না। আমি তাই ফলো করছি। নিজের ছেলেমানুষিটাকে ছেড়ে বুঝদার হবার চেষ্টা করছি।
আয়াতঃ বুঝলাম তুমি ম্যাচিওর হবার চেষ্টা করতেছো। কিন্তু তুমি কি খেয়াল করেছো বেশি বড়মানুষি দেখাতে গিয়ে তুমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছো!
তনয়াঃ ঠিক জানি না।
আয়াতঃ তাহলে জানার চেষ্টা করো। এভাবে নিজের থেকে যদি দূরে চলে যাও তবে খুশি থাকতে পারবে না।
দেখো তনয়া সবার একটা অতীত থাকবেই। সে তুলনায় তোমার অতীতটা নেহাৎ ছেলেমানুষি কিন্তু তবুও সেটা মনের মাঝে দাগ কেটে যায়। তারপরও অতীতটাকে ভুলে থাকাই ভালো নয়কি? কি বললাম বুঝলা কিছু?
তনয়াঃ হুমমম স্যার।
আয়াতঃ তাহলে আবার আগের তনয়া হয়ে যাও! কেমন? তবে হ্যা দুষ্টমির পরিমান কিন্তু আগের মত রেখো না কারন আমি জানি তনয়ার দুষ্টমি অন্যদের উপর কতটা ভারী পরে!
আয়াতের কথা শুনে দুজনেই হেসে দিলো।
তনয়াঃ কিন্তু স্যার আমি আবার আগের তনয়া কিভাবে হবো?
আয়াতঃ সেটাও কি আমি বলে দিবো?
তনয়াঃ প্রশ্ন যখন আপনি তুলেছে উত্তর ও আপনাকেই দিতে হবে? বুঝলেন?
আয়াতঃ ওকে ওকে। প্রথমে নিজের মাথার মধ্যে বড় হবার যে চিন্তা গুলো আছে না সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দাও। তারপর আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখো নিজের দুষ্টমিগুলো নিয়ে ভাবো আর দুষ্টমি করো।
তনয়াঃ অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার আর এই ম্যাচিওর হওয়ার চক্করে আমিও হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। যাক বাবা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
এর মধ্যে আয়াতের মা নাস্তা নিয়ে আসলেন।
তনয়াঃ আন্টি এগুলোর কি দরকার ছিলো?
আয়াতের মাঃ চুপ একদম চুপ। এতদিন ধরে আমাদের বাসায় পড়তে আসিস অথচো তোর একটু যত্ন করতে পারি না। আসলে এতগুলো ছেলে মেয়ের মধ্যে তোকে আলাদা করে দেখলে ওদের খারাপ লাগতে পারে? তাই?
কিন্তু শত হলেও তুইতো নিজেদের মেয়ে!
তনয়াঃ মানে?
আয়াতের মাঃ মানে তুই আয়াতের বাবার বন্ধুর মেয়ে। তোর বাবার সাথে কত বছরের পরিচয়। আর তোর বাবা মা তো প্রায় আমাদের বাসায় আসে কিন্তু তোকে কখনো নিয়ে আসেনি। সবসময় কোন না কোন বাহানা বানিয়ে দিতো
নে এবার চুপচাপ খাতো!
তনয়া দেখলো দু বাটি আইসক্রিম। বাকিগুলো রেখে সেটাই নিলো। আয়াত আইসক্রিম এর অন্য বাটিটা নিতে যাবে এর মধ্যে তনয়া বললো——
তনয়াঃ একদম হাত দিবেন না!
আয়াতঃ কেন?
তনয়াঃ ওখানে বাকি যে খাবার রাখা আছে সেটা খান। আমার আইসক্রিম এর দিকে একদম নজড় দিবে না। আন্টি ওটা আমাকে দিয়েছে।
আয়াতঃ দু বাটি সব একা খাবে?
তনয়াঃ হ্যা তো! দশ বাটি আইসক্রিমেও আমার কিছু হবে না। যান আন্টির কাছে গিয়ে চেয়ে খান।
আয়াত মুচকি হেসে দেখলো পাগলি মেয়েটা বাচ্চাদের মত আইসক্রিম খাচ্ছে কিন্তু চোখ বন্ধ করে।
আয়াতঃ তারমানে দুষ্টমির শুরুটা আমাকে দিয়েই করলে?
তনয়াঃ হি হি!
তারপর পড়াশুনা শেষে তনয়া বাড়ি গিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে বললো——
তনয়াঃ কোন অতীতটা ভুলবো? পাশের বাসার টিয়াকে যে চুলকানির ঔষধ লাগিয়ে নাচিয়েছিলাম নাকি ক্লাসে স্যারের বেঞ্চের নিচে চুইমগাম রেখে দিয়েছিলাম নাকি পাশের বাসার আন্টির গাছের ফুল চুরির বিষয়টা?
আরো অনেক আছে? ধ্যাত ভাল্লাগে না। কাল আবার স্যারকে জিগেস করতে হবে?
পরের দিন আবার আয়াতদের বাসায় গেলো। কিন্তু আজ এখনো কেউ পড়তে আসেনি কেন?
ডোর বেল বাজালে আয়াত দড়জা খুললো।
আয়াতঃ তুমি আজ পড়তে আসলা কেন?
তনয়াঃ কেন স্যার?
আয়াতঃ আরে আমিতো তিন্নিকে (তনয়ার ক্লাসমেট) ফোন করে বলেছি আজকে পড়াবো না। সবাইকে জানিয়ে দিতে।
তনয়াঃ ওহ তাহলে মনে হয় আমাকে জানাতে ভুলে গেছে। কেন পড়াবেন না?
আয়াতঃ আসলে মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। তাই।
তনয়াঃ ওহ! তা আমি কি আন্টিকে দেখতে পারি?
আয়াতঃ হ্যা অবশ্যই ভিতরে আসো।
তনয়া ভিতরে গিয়ে আয়াতের মায়ের সাথে দেখা করে। তার অবস্থার কথা জানতে চাইলো। তারপর আয়াতকে বললো—-
তনয়াঃ স্যার একটু কনফিউসন ছিলো।
আয়াতঃ হ্যা বলো?
তনয়াঃ শোনেন আন্টি স্যার আমাকে কিছু অতীত ভুলে যেতে বলেছে। কিন্তু আমি ঠিক ভেবে পাচ্ছি না কোনটা ভুলবো আর কোনটা মনে রাখবো?
আয়াতের মাঃ তা অতীত গুলো কি আমাদের বলা যাবে?
তনয়াঃ কেন বলা যাবে না। অবশ্যই!
তারপর তনয়া শুরু করলো তার সকল দুষ্টমির কাহীনি। শুরু করেছে তো করেছে শেষতো হচ্ছেই না। আর এদিকে আয়াত আর ওর মা তনয়ার দুষ্টমির কথা শুনে হাসতে হাসতে অবস্থা বারোটা।
আয়াতের মাঃ তনয়া এসব কাজ তুমি করেছো?
তনয়াঃ হ্যা আন্টি। আরো আছে কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু এর মধ্যে থেকে কোনটা ভুলবো আর কোনটা মনে রাখবো? তাই নিয়ে কনফিউজড আছি।
আয়াতঃ একটাও ভুলতে হবে না।
তনয়াঃ আরে আপনিইতো অতীত ভুলতে বললেন?
আয়াতঃ ভুল হয়েছে আমার ! আমি ভুলে গেছিলাম যে তুমি তনয়া! তুমি সবসময় আমার অস্র আমার উপরই প্রয়োগ করো।
তনয়া ঠোট ফুলিয়ে আয়াতের মায়ের দিকে তাকালো। তিনি তখনো হাসছেন।
আয়াতের মাঃ তোর মত মেয়ে থাকলে তাদের ঘর সবসময় খুশিময় থাকবে!
তনয়াঃ রিয়েলি আন্টি! এখন কেমন লাগছে আপনার?
আয়াতের মাঃ হ্যা সত্যি। যা অসুস্থ ছিলাম তোর কথায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। আর আমার এখন খুব ভালো লাগছে।
তনয়াঃ আন্টি আমি এখন উঠি তাহলে। নিজের খেয়াল রাখবেন। বাই আন্টি।
আয়াত তনয়াকে দড়জা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আবার ডাক দিলো
আয়াতঃ তনয়া শোন!
তনয়াঃ জ্বি স্যার!
আয়াতঃ তুমি কালকে বলেছিলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো! কিন্তু সে বিশ্বাসের ভিত্তি বা কারনটা জানতে পারি?
তনয়াঃ একটা চৌদ্দ পনের বছরের মেয়ে আপনাকে প্রপোজ করেছে চাইলেই আপনি তার দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারতেন? কিন্তু আপনি তা না করে মেয়েটাকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। বিশ্বাস করার জন্য এটাই যথেষ্ট নয়কি? স্যার আমি আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করি। আর—–
আয়াত মুচকি হেসে বললো সাবধানে যেও।
তনয়াঃ বাই স্যার।
আয়াত তারপর দড়জা আটকে ভিতরে যেতেই শোনে তনয়ার চিৎকার
আয়াত দ্রুত দড়জা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলো———
চলবে——-