ক্যাকটাস

ক্যাকটাস !! Part- 17

Tumhare Siva Kuch Na Chaahat Karenge
Ke Jab Tak Jiyenge Mohabbat Karenge,,,,,,,
আশেপাশের কারো বাড়ির সাউন্ড বক্স থেকে গানটি ভেসে আসে বিছানায় শায়িত রাফসানের কানে। এতোক্ষনের চাপা ব্যথা মুহূর্তে হু!হু! করে বেড়ে বিন্দুমোচন রুপান্তরিত হলো। চোখের সম্মুখে দিবালোকের আলোর ন্যায় উদ্ভাসিত নীরা। যে চাওয়া এতোদিন বুকের কোনে দাফন করতে ব্যতিব্যস্ত ছিল। আজ মনে হচ্ছে কেন এতো অসহায়ত্বের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি? কেন এতো যন্ত্রণা! কেন তাকে চাওয়াতে এতো বাঁধা? রাফসান বালিশে মুখ গুঁজে প্রাণপণে চিৎকার করলো। তার চিৎকার একসময় কান্নার তোড়ে ক্ষীণ। একবার মনে হলো এই অসহায়ত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি পাই। পরক্ষনেই মাতৃমূর্তি হয়ে চোখের তারায় উদিত হলো তার জন্মদাত্রী। মা! এই মা’কে ধোঁকা দিয়ে কী করে যাবে সে? কেউ তো নেই তার রাফসান ছাড়া। রাফসান নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। দরজা,জানালা বন্ধ করে গানের আগত শব্দ রুখে দেয়। বিছানার এককোনে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে বসে রাফসান৷ দু’হাতে সমস্ত জোর দিয়ে খাটের কোনার অংশ চেপে ধরে। গম্ভীরমুখে স্বগতোক্তি করে,
” এই প্রচন্ড গতির আবেগকে আমি রুখে দেব। কী হবে তাতে! হ্যাঁ পাথর হয়ে যাবে গতিহীন আবেগ হওয়ায় এ হৃদয়। হোক! হোক পাথর এই হৃদয়, এই দেহ। তবুও মা’কে কষ্ট দিতে পারব না। হলাহলের মতো নিজেই যন্ত্রণার বিষ ধারণ করব, তবুও নীরাকে এই বিষে বিষাক্ত হতে দিতে পারব না। আমার মন তাকে চেয়েছে। না করিনি পাপ তাকে ভালোবেসে। ভালোবাসায় পাপ হয় না,ভালোবাসা পবিত্র। সেই পবিত্রতাকে কলুষিত হতে দেব না। বিনিময়ে সমস্ত পৃথিবীর প্রেমিকের চোখে হলাম না হয় ভীরু,কাপুরুষ!”

ঢাকা থেকের আসার দু’দিন পরও রাহেলা রাফসান মুখোমুখি হয়নি। রাফসান অফিস শেষে সোজা রুমে চলে আসে। টুসি খাবার দিয়ে আসলেও তেমন খায় না। রাহেলাও ছেলের মতো চুপচাপ বসে থাকেন ঘরে। টুসি এ দু’দিন চুপ থাকলেও আজ থাকল না। মায়ের ঘরে গিয়ে জিনিসপত্রের উপর রাগ ঝাড়ছে। শব্দ করে খুলছে আর প্রচন্ড বারি দিয়ে আটকাচ্ছে আলমারির দরজা। রাহেলা একপাশ হয়ে শুয়ে শুয়ে তসবিহ গুনছিল। টুসির শব্দের উৎপাতে বিরক্ত হলেন তিনি। মন মেজাজ এমনিতেও তার বেশ একটা ভালো না। ঘার ঘুরিয়ে ধমকের সুরেই টুসিকে বললেন,
” এমন করে কাজ করছিস কেন? নিঃশব্দে কাজ করলে কর নয়তো দূর হ চোখের সামনে থেকে।”
টুসি যেন এতোক্ষণ এ কথার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। রাহেলার কথা শেষ না হতেই চেঁচিয়ে উঠল সে। বললো,
” হ সব দূর হয়ে যাই। আপনে একা থাকেন আপনার মতো। করেন যা মন চায় আপনার।”
টুসির গলার ঝাঁঝে বিব্রত রাহেলা বিছানার উপর উঠে বসে। রাগী গলায় বলেন,
” ঐ তুই চোপা নারাস কেন? সকাল সকাল এসব কী শুরু করছোস? তোর ভাই আমাকে শান্তি দিল না। তুই ও কী তাই করবি নাকি?” ছেলের কথা বলতেই বুকটা হু হু করে উঠল রাহেলার। এতোবড় ছেলের গায়ে তিনি হাত তুলেছেন।ছিঃ কতো খারাপ কাজই না করেছেন তিনি। কতো কষ্টই না পেয়েছে তার রাফসান। রাহেলার চোখ ভিজে আসে। টুসি মায়ের সিক্ত গলার স্বরে দমে যায়। চুপচাপ এসে বসে মায়ের সামনে। মায়ের হাতটা দু’হাতে নিয়ে বলে,
” আমি জানি তুমি ভাইয়ার জন্যে কতো কষ্ট পাচ্ছ? এমন কেন করলে তুমি আম্মা!”
” আমার ভুল হয়ে গেছে রে টুসি। মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। আমার বাবুরে কেন যে মারতে গেলাম?” রাহেলা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদে। টুসি পাশে সরে এসে মাকে এক হাতে কাছে টেনে বলে,
” তুমি চলো আমার সাথে ভাইয়ার রুমে। ভাইয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ঠিকমতো খাচ্ছেও না ভাইয়া। চলো আম্মা!”
” না! ও আমারে রাগাইলো কেন? ওরে আসতে ক। আমি যাব না।”
” আবার জেদ করছ তুমি? এই না কাঁদছ?”
” কাঁদব না তো কী করব? কপাল করছি কাঁদার। আমি বেশি কিছু কী চাইছিলাম ওর কাছে? শুধু পুত্রবধূ হিসেবে মেহেরকে চেয়েছিলাম। দিল মূল্য আমার চাওয়ার। ও নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছিল যার জন্য মেহের ঐ ছেলেরে বিয়ে করলো হুট করে। সব দোষ ওর।” রাহেলা তেজে ওঠে
” তাইলে তুমি যাবা না উপরে?” টুসি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখে।
” না!” গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রাহেলা।
” তুমি আসলেই একটা ত্যাঁড়া বুঝলা আম্মা। খালি আছ পোলার বিয়া নিয়া। তোমার পোলা বিয়ে কেন করতে চায় না জিগাইছ একবারও?” টুসি দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে
” জিজ্ঞেস করলে কী বলবে আমাকে ও? আমারে ত্যাঁড়া বলছ? তোরা দুইটা কী? কোনো কথা শুনোস আমার? যা আমার চোখের সামনে থেকে। ভাই বোন মিলে ভালো থাক যা। আমি মরি বাঁচি তোদের কী? যা!” হাত নাড়িয়ে দরজা দেখায় রাহেলা। টুসি দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
” তোমার সাথে কথা বলায় বৃথা। ছেলের মুখ চোখের দিকে একটু তাকাইয়ো আম্মা। তাইলে বুঝবা ছেলে বিয়া কেন করতে চায় না। আমার তো মনে হয় তোমার জন্যেই করতে চায় না।”

” ঐ টুসি! এসব কী বলোস তুই আমারে? আমার জন্যে করতে চায় না মানে কী?” মেয়ের উপর চিৎকার করে ওঠে রাহেলা
” আমি বলতে যামু কেন? তোমার পোলা তুমি আবিষ্কার করো গিয়া মানে কী? বউ! বউ! না করে পোলার মন বোঝো আগে আম্মা। সংসার তুমি করবা না বুঝছ? যার জীবন তার পছন্দ- অপছন্দ,মতামতের গুরুত্ব দেওয়া শেখো। আদ্দিকালের মানুষের মতো যারে তারে ধইরা আইন্যা বিয়া কর! বিয়া কর! বইলা চিল্লানো বন্ধ করো এবার।”
টুসি সশব্দে দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে যায়। রাহেলা ভ্রুকুটি করে বন্ধ দরজায় তাকিয়ে ভাবনায় ডোবে। টুসির কথার সাথে নিজের মন মানসিকতা মেলানোর চেষ্টা চালায়। তার কী ভুল হয়েছে কোথাও? কী ভুল হয়েছে? সমর্থ ছেলের বউ দেখতে চাওয়াতে ভুল কোথায়? নাকি অন্য কিছু লুকায়িত এর মধ্যে? রাফসানের কী হয়েছে? কেন এমন পরিবর্তন তার ছেলের? এতোটা গুমোট ভাব তো কোনোদিনই ছিল না। রাহেলা বেশকিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা শেষেও বুঝে উঠতে পারলো না কিছু। তার কষ্ট একজায়গায় টিকে রইল। মেহের কে পুত্রবধূ না করতে পারায়।
নীরা আগামীকাল কক্সবাজারের হিমছড়ি যাবে। সেখানেই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মনটা অস্থির ওর। এতোদূর একা যাবে ভাবতেই কেমন ভয়, সঙ্কোচে অসাড় অসাড় লাগছে। শারমিন নীরার কক্সবাজার যাওয়ার কথা শুনে বেজায় আনন্দিত। মেহেরকেও মোবাইল করে জানানো হয়েছে। মেহের খুশি হয়েছে সাথে সতর্ক করে দিয়েছে আশেপাশের বিপদ থেকে। এতোদূরে যাবে নীরা যেন নিজের খেয়াল রাখে। শ্বশুরবাড়ির ব্যস্ততায় সে আসতে পারছে না, কিন্তু ম্যানেজারকে যা বলার বলে দেবে। নীরার সাথেও কথা হয়েছে মেহেরের। নীরার মনোবল বাড়াতে যা যা বলার প্রয়োজন মেহের বলেছে। নীরার ভেতর আগের চেয়ে ভয় একটু কম কাজ করছে, তথাপি মনটা তার অশান্ত।
অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলে মন অন্য ভাবনা ভাবার অবকাশ পায় না। আজ সে ব্যস্ততাও নেই। যারা আগামীকাল কক্সবাজার যাবে। অফিস কতৃপক্ষ তাদের আজ জলদি ছেড়েছে। নীরা বাসায় এসে প্যাকিং সেরে নেয়। শারমিন রাতে বসে বসে কীভাবে পার্সোনালি নীরা চলবে, ফিরবে তার একটা মোটামুটি ধারণা দিয়ে দিল। বলে দিল কোনো সমস্যা হলে তাকে কল করতে। নীরা ঘার নাড়িয়ে সম্মতি জানায় বোনের সকল কথায়। রাতে দু’ বোন বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে মুখে। শীতের কাঁপুনি দেওয়া বাতাস গায়ে লাগতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে নীরার। নীরা অপলক চেয়ে আছে চাঁদের দিকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড্ড ভালো লাগে নীরার। পাশে ঘুমন্ত শারমিনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বাইরের শীত পবনের অযাচিত ছোঁয়ায়। কম্বল গলা অব্দি টেনে ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে বলে,
” নীরা জানালা লাগা! সাথে পর্দাও টেনে দে।”

নীরা মুখটা বেজার করে শারমিনের কথা রাখল। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে রইল সে। আগামীকালের লং জার্নির চিন্তায় সারারাত ঘুম এলো না। যদিওবা ভোরের দিকে দু’চোখ একটু লেগে এসেছিল সেটা ভাঙল দুঃস্বপ্নের কারনে। যেদিন থেকে কক্সবাজার যাবে বলে ঠিক হয়েছে। সেদিন থেকেই উদ্ভট দুঃস্বপ্ন সে দেখছে। দুঃশ্চিতার ফল ভেবে নীরা দুঃস্বপ্নটা বার বার এড়িয়ে যায়। আজও তাই করল। তবুও বুকটা অনেকক্ষণ যাবত ধুকপুক করে কিছুসময় থেমে, আবার আগের মতো হলো অস্থির, অশান্ত।
সকালের গাড়িতেই রওনা হলো নীরা সহ আরও দশজন। ছয়জন সাধারণ কর্মচারী তার মতো, বাকি চারজন উর্ধ্বতন অফিস কর্মচারী। এসি বাসের জানালা সংলগ্ন সিটটাতে বসেছে নীরা,পাশে বসবে বলে এগিয়ে এলো তার সিনিয়র আমরিন আফরোজ৷ নীরার বেশ পছন্দ আমরিন। সে কিন্তু নীরার অফিসের নয়, হেড অফিসের। তবে প্রায়শ অফিসিয়াল কাজে এখানে আসা যাওয়া করে। অনেকেই বলে ম্যানেজারের সাথে তার সম্পর্ক আছে। নীরা অতোসব কথায় যায় না। তার আমরিনকে ভালো লাগে ব্যস এতোটুকুই। আমরিন নীরাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসিমুখে বললো,
” নীরা রাইট?”
” জি আপু!” আমরিন বসতেই শারমিন উঠে এলো হন্তদন্ত হয়ে। নীরা বেশ অবাক বোনকে আবার বাসে দেখে। শারমিন মোবাইলটা আমরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” মেহের কথা বলবে আপনার সাথে।”
” মেহের!” আমরিন উচ্ছ্বাসিত হলো। নীরা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে আমরিনকে দেখে যাচ্ছে। হোয়াইট আবায়ার উপর হোয়াইট, ব্লু কম্বিনেশনের হিজাব পরিপাটি করে বাঁধা। মুখটা উন্মুক্ত রেখেছে। নীরার চোখে আরমিন সুন্দরের চেয়েও বেশি কিছু। মেহেরের সাথে কী কথা হলো স্পষ্ট শুনতে না পেলেও বুঝতে পারল তাদের কথার কেন্দ্র বিন্দু সে। আমরিন হেঁসে হেঁসে কথা শেষ করে শারমিনকে বললো,
” তুমি চিন্তা করো না। তোমার বোন মনে করো এখন থেকে আমারও বোন। সো ডোন্ট ওয়ারি।”
” থ্যাংকস!” আমরিনের দিকে চেয়ে সৌজন্যের হাসি দিল শারমিন। নীরার দিকে তাকিয়ে বললো,
” এই নীরা! আপু যা বলে শুনবি। তাকে না বলে কোথাও যাবি না ঠিক আছে?”
নীরা ঘাড় নাড়াল। শারমিন আরও দু’তিন কথা বলে নেমে গেল বাস থেকে । যথাসময়ে বাস ছাড়ল। বাস ছাড়তেই শেষবারের মতো শারমিনকে দেখলো নীরা। কান্না পেল খুব ওর শারমিনকে ছেড়ে এতোদূর যাচ্ছে ভেবে। ইচ্ছা হচ্ছিল এখনই নেমে যেতে। সবসময়ই কী আর ইচ্ছা পূরন হয়? হয় না! নীরা মনমরা হয়ে বসেছিল জানালার বাহিরে দৃষ্টি রেখে। তার দৃষ্টি ছলছল।
বেশখানিকটা পথ অতিক্রম করার পর আমরিন কথা বললো ওর সাথে। বললো,
” ভয় হচ্ছে? ”
নীরা নত মুখে ঘাড় নাড়াল। আমরিন মৃদু হেঁসে বললো,
” আল্লাহ ভরসা! ভয় করবে না একদম। ভয় মানুষকে মরার আগেই মেরে ফেলে। ভাবনায় শুধু একটা কথায় রাখবে আমিই আমার সব। যা হবে দেখা যাবে। মনোবল হারাবে তো সব হারাবে। মানুষের জীবনের পথ কঠিন, মেয়ে মানুষের জীবনের পথ তারচেয়েও বেশি কঠিন৷ কঠিন পথে চলতে গেলে এতো দূর্বল চিত্ত থাকা চলে না নীরা। বি স্ট্রং!”

নীরার খারাপ লাগা কমে গেল। আমরিনের প্রতিটি কথাতে মনে সাহস পেল সে। কথায় কথায় আমরিন তার এবং মেহেরের পরিচয়ের সূত্রটা কবে থেকে সেটাও বললো।নীরার বিষয়েও খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে আরমিন। আরমিনও নীরার মতোই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তবে এখন সে একাই থাকে। কাজের সূত্রধরেই মেহেরের সাথে তার পরিচয় হয়। নীরা আগ্রহ নিয়ে সব শুনছে। বেশ অমায়িক ব্যবহার আমরিনের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সহজ সম্পর্ক হলো দুজনের। নীরা এখন বেশ সহজ এবং সাবলীল বোধ করছে বাসে। আরমান নীরার বিপরীত দিকের সিটে বসেছে। ইশারায় হাসি বিনিময় হলো নীরার সাথে ওর। বাসে সবাই যার যার মতো গল্প করে,ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছে। বাসে উঠলে বমি ভাব হওয়ার প্রবল সম্ভবনা থাকে নীরার। তার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে পলিথিন, কমলালেবু ব্যাগে রাখা। বমি নিরোধক ট্যাবলেটও খেয়েছে সে। আমরিন বুদ্ধি দিল ঘুমিয়ে পড়লে বেটার হবে তার ক্ষেত্রে। নীরা সেটাই চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। গত কিছুদিনের চিন্তায় তার যে ঘুমের ঘাটতি হয়েছিল। সে ঘাটতি অনেকাংশে লাঘব হলো বাসে ঘুমিয়ে। দু’ধারের জনাকীর্ণ অংশ ছেড়ে নিরিবিলি ছায়াবিথী রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। সময়টা শীতের হলেও বাইরে ওঠা ঝলমলে রোদের তাপে বাসের ভেতরটায় গরম অনুভূত হলো। সবার কথায় লো ভলিউমে এসি ছাড়া হয়েছে। এখন বেশ লাগছে সবার। সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমন্ত কেউ কেউ। আমরিন সামনে বসা ম্যানেজার মিনহাজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মিটমিটিয়ে হাসছে। ম্যানেজার সতর্কে ঘাড় বাঁকিয়ে বার বার আমরিনকে দেখছে আর হাসছে ঠোঁট টিপে। তাদের এই লুকোচুরি প্রেমবিনিময় চলতে থাকল গন্তব্য পর্যন্ত।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। যেদিকে চোখ যায় ছোট বড় গাছের সারি,ঝোপঝাড়। মাথার উপর প্রিয় চাঁদ। আজ আর প্রিয় নয় বড়ো অপ্রিয় ঠেকছে চাঁদটাকে। অন্ধকারে ভূতূড়ে লাগছে সবকিছু। এক পা এগোতেই সম্মুখ আঁধারে আড়াল সুউচ্চ নাম না জানা গাছের ধাক্কায় কপালে বারি খেল সে। তখনই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চারপাশে অজানা পাখির কূজনে মুখরিত। গা শিউরে উঠলো নীরার।এক পা এগোতেই চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেললো কেউ তাকে। আতঙ্কিত নীরা দেখল অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে এসেছে ভয়ংকর এক মানবমূর্তি। নীরা চিৎকার করতে চেয়েও পারছে না। মনে হচ্ছে কন্ঠনালি চেপে ধরে আছে কেউ। দমবন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ংকর মানবমূর্তিটি তাকে হাত ধরে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুকনো পাতার উপর পড়ে থাকা ছোট বড় ডাল,কাটার আঘাতে পিঠটা তার ছিঁড়ে গেল বোধহয়। না সে পারছে না শব্দ করতে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে বার বার। চোখের সম্মুখের অন্ধকার ক্রমশ আলো হতে লাগল। কই সেই আঁধারে আলোতে খেলা চাঁদ? কই সেই ভুতুড়ে গাছের সারি?
” নীরা! এই নীরা!” আমরিনের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নীরা। এই কনকনে শীতে ঘেমে নেয়ে একাকার সে। আমরিন নীরার রক্তলাল সিক্ত চোখে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় বলে,

” কী হয়েছে তোমার? দুঃস্বপ্ন দেখেছ? নীরা! এই মেয়ে কথা বলো?”
আমরিনের হাতের হালকা ঝাকুনিতে নীরার হুশ ফেরে। ভীরু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” হুমম!” অস্ফুট আওয়াজ হতেই গলার উপর হাত রাখে নীরা। এই তো কথা বলতে পারছে সে। তবে কী ঐসব দুঃস্বপ্ন ছিল? নীরা শরীরে বল পেল না। কাঁপা, দূর্বল হাতে মুখ চোখ মুছে নিল গায়ের ওড়না দ্বারা। আমরিন ওর গায়ের চাদর খুলে একপাশ রেখে পানির বোতল এগিয়ে দিল। ওপাশে সবাই প্রশ্ন করলে আমরিন জানালো নীরা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সবাই কিছুক্ষণ কৌতূহলে চেয়ে আবার আগের মতো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নীরা পানি পান করে মাথা ঠেকাল জানালার কাচে। বাইরের জনবহুল ব্যস্ত সড়কের চারপাশটায় চোখ রেখে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো নীরা। ঘুম এরপর আর এলো না চোখে। ভাবনায় কেবল ঐ জঙ্গল আর ঐ ভয়ংকর মানবমূর্তি রয়ে গেল। গত কিছুদিন ধরে এমনই স্বপ্ন সে দেখছে। কেন যেন অজানা কারনে বুক কাঁপছে। মনে মনে বারংবার বিপদ মুক্তির দোয়া পড়তে লাগল।