ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি- সিজন ২ – Part- 16

পুরো সাত দিন পর বাচ্চাটার ফিজিক্যাল কন্ডিশন স্টেবল হলো । ডাক্তার ওকে মায়ের কাছে যাওয়ার পারমিশন দিলেন কিন্তু খুব টেক কেয়ার করতে হবে । এই সাতদিন হসপিটালেই ছিলো মিথিলা । সার্বিক দিক ও আর রাইদ দেখেছে ।
তবে রাইদ নীরারও খোঁজ খবর নিয়েছে । রফিক খুব ভালো একটা কাজ করেছে কথার জ্বালে নীরা কে ঐ বাসায় আটকাতে পেরেছে ।
নীরা ই লিন্ডা কি না এর পরীক্ষা হবে আজ রাতে ।
এদিকে অন্তর আজ মিথিলা কে কল করেছে । আজ রাতে ই তারা যাবে শব্দের বাসায় এভিডেন্স আনতে ।
যেহেতু রাফনিদ আর বাবু কিছুটা সুস্থ তাই তানভীর আর মিতা বলেছে মিথির আর হসপিটালে থাকার দরকার নেই ও আজ বাসায় যাক রেস্ট করুক ।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মিথিলা বেলা বারোটার দিকে বাসায় চলে গেলো । ওকে বাসায় নামিয়ে রাইদ নিজের বাসায় গেলো এবং রফিক কে বললো নীরা কে এটাসেটা বুঝিয়ে সে যাতে ঢাকায় চলে আসে নীরাকে নেয়ার দরকার নেই । রফিক রাইদের কথা অনুযায়ী একা একাই আসছে ।
রাইদ দেখতে চায় ছাড়া পেয়ে ওদের প্রথম স্টেপ টা কি হয়! এজন্য ও আজ রাতে এই বাসাতেই থাকবে চিন্তা করেছে ।
বাসায় পৌঁছে মিথি কে টেক্সট করে দিলো ও যাতে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করে , একটা ইম্পর্টেন্ট কাজে আটকা পড়ে গেছে আজ ফিরতে পারবে না ।
মিথি ফিরতি মেসেজে ছোট্ট করে লিখলো,”টেক কেয়ার”
বাকিটা সময় কাটলো চলনসই ভাবে । শুয়ে বসে কাটালো দু’জন ।
সন্ধ্যায় আরেকবার রাফনিদের সাথে দেখা করে বাসায় এসে প্রস্তুতি নিতে থাকলো মিথিলা । অন্তর কে কল করে আসতে বললো ওদের বাসায় ।
শীতের মৌসুমে দশটা বাজলেই ভীষণ রাত ।
অন্তর এসে পৌঁছালো সাড়ে দশটায় । সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে আল্লাহর নাম করে বেরুলো শব্দের বাসার উদ্দেশ্যে ।
পথে হুট করে রাইদের কথা মনে পড়ছিল, ওর খোঁজ নেয়া হয়নি সন্ধ্যার পর থেকে ।ইচ্ছে থাকলেও এই মুহুর্তে তা দমন করতে হলো ।
শব্দের বাসায় পৌঁছাতে বেঁজে গেল রাত্রি বারোটা ।
কুয়াশার চাদরে মোড়ানো চারিদিক । শুনশান নীরবতা মনের মধ্যে অদ্ভুত ভয়ের জন্ম দেয় ।
তাকে নামিয়ে অন্তর গেছে গাড়ি সাইড করতে ।
মিথিলার মনে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে , কেউ যদি দেখে নেয়?
অন্তর গেছে তো গেছে এখনো আসার নাম নেই ।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মিথিলা , বারবার ঘড়ি দেখছে মোবাইলে ।
এমন সময় কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ । চমকে ফিরে তাকাতেই দেখে অন্তর । কিঞ্চিৎ হেসে অন্তর প্রশ্ন করে_
— ভয় পেয়ে গেছিলেন বুঝি?
— হ্যাঁ একটু ।
— না ভয়ের কিছু নেই । কেউ দেখবে না সমস্যা নেই । চলুন জলদি ।
— হ্যাঁ চলুন ।

অন্তরের পিছু পিছু যায় মিথিলা । পেছনের দরজাটা গ্যারাজের মুখে । ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে একদম নিঃশব্দে ওরা গ্যারাজ পার হয়ে বিল্ডিংয়ে ওঠে ।
চাবি অন্তরের কাছেই ছিলো । মেইন ডোর খোলার পর মিথিলা লাইট জ্বালাতে চাইলে অন্তর দেয় না বাইরের মানুষ জেনে যাবে ।
ফোনের মৃদু আলোতেই তাদের হাতড়ে বেড়াতে হয় ঘরময় ।
শব্দের রুমের দরজার লক , আলমারির লক খুব ইজিলি অন্তর কে খুলতে দেখে একটু অদ্ভুত লাগে মিথিলার । ও হাসতে হাসতে বলে, আপনি তো সব চাবি সংগ্রহ করে রেখেছেন অন্তর ভাই ।
জবাবে অন্তর বলে,” না করে রাখলে পরের কাজগুলো করা দুঃসাধ্য হয়ে যাবে তো”
মিথিলা আর কিছু বলে না ।
আলমারির ভেতরে সব কাপড় গুলো সরিয়ে দেখে কিছু নেই কোনো বক্স নেই ।
— অন্তর ভাই এখানে তো কিছুই নেই ।
— ঠিকমত খুঁজে দেখতে হবে । আপনি আলমারি দেখুন আমি ওয়ারড্রোবে দেখছি ।
— আচ্ছা ঠিকাছে ।
মিথি সব কাপড় আলমারি থেকে নামিয়ে দেখতে লাগলো ।
নাহ এখানে নেই । ও অন্তর কে আওয়াজ দিলো_
— ভাই এখানে তো কিছুই নেই । আপনি পেলেন?
— উঁহু কিন্তু স্যার যে বলেছিলেন আলমারিতে পাবো ।
— কিন্তু পেলাম না তো কিছু ।
— আমি একবার দেখি , আলোটা ধরুন এদিকে ।
মিথিলা আলো ধরতেই অন্তর আলমারির কেবিনেট গুলোতে দুহাত দিয়ে প্রেস করে দেখছিলো ।
আলমারির একদম নিচের তাকে এসে প্রেস করতেই নরম কাঠ মাঝখান দিয়ে ভেঙে গেলো ।
অন্তর হাত বাড়িয়ে ফোনটা চাইলো ।
নিচু হয়ে বসে আলো দেখালো মিথিলা । ভাঙা কাঠ সরাতেই একটা কাঠের বক্স আর মোড়ানো কাগজ নজরে আসলো তাদের ।
সেটা বের করে বিছানায় এনে খুলে দেখলো ।
কাগজ টাই হলো সেই ব্লু প্রিন্ট আর বক্সের ভেতর নিশ্চয়ই বাকি এভিডেন্স আছে ।
অন্তর একটা হাসি দিয়ে বললো_
— ইয়েস । পেয়ে গেছি আমরা ।
মিথিলাও পাল্টা হেসে মাথা নাড়লো ।
অন্তর বললো_
— দ্রুত হাতে কাপড় গুলো গুছিয়ে রেখে আমাদের বেরুতে হবে।
— হ্যাঁ আমি গুছিয়ে নিচ্ছি ।
— আমিও হেল্প করি ।
দুজন হাতে হাতে কাজ করে সব আগের মত পরিপাটি করে রেখে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ।
যেমন নিঃশব্দে ওরা ঢুকেছিলো তেমন নিঃশব্দে বেরিয়েও গেলো ।
কিছুটা দূরেই গাড়ি রাখা ছিলো । দু’জনে হেঁটে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে গেলো ।
আপাতত পরিকল্পনা মিথিদের বাসায় যাওয়া ।

___
রাইদ অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে আছে । এইতো কিছুক্ষণ আগেই কেউ একজন এসেছে ওর বাসায়৷ ঘরে কিছু একটা খুঁজছে । ও জানে লিন্ডা’ই এসেছে । নিশ্চয়ই ডায়মণ্ড খুঁজছে?
নীরা ই যে লিন্ডা তা বুঝতে দেরি হয়নি । ডায়মণ্ডের খবর জানে শুধুমাত্র চারজন । বিয়ের পরদিন শ্বাশুড়ি ওর হাতে তুলে দিয়েছিল এটা নাকি মেজর নাদিমের হবু জামাইয়ের জন্য রেখে যাওয়া গিফট ।
মিথিলা আবার খুব উৎসাহ নিয়ে সব গয়না বের করে দেখিয়েছে নীরা কে, সেখানে ডায়মণ্ডটাও ছিলো ।
যেভাবে ব্যক্তিটা এসে সোজা ওদের লিভিং রুমেই ঢুকে গেছে বোঝাই যায় সে এই বাড়ি সম্পর্কে ধারণা রাখে ।
না জানি আজ কয়টা খুন করতে হচ্ছে ওকে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার থেকে ওঠে রাইদ । ড্রয়ার খুলে “এম ১৯১১” বন্দুকটা বের করে লোড করে নিয়ে নিঃশব্দে পাশের ঘরে চলে গেলো ।
জ্যাকেট পরিহিতা মেয়েটা আলমারির কাপড় সব এলোমেলো করে দিয়েছে অলরেডি ।
খুব সাবধানে পা ফেলে একদম মেয়েটার পেছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখলো ওর কাজকারবার তারপর খু খু করে কেশে বললো_
— এক্সকিউজ মি ম্যাম আপনি তো সব কাপড় এলোমেলো করে দিচ্ছেন । আপনার কি চাই আমাকে বললে কিন্তু আমি খুঁজে দিতে পারি ।
রাইদের গলা পেয়ে মেয়েটা চট করে ঘুরে তাকালো । ওকে একদম নিজের সামনে দেখে ভয়ে আলমারির সাথে লেগে গেলো প্রায় । আমতা আমতা করে বললো_
— খবরদার এগিয়েছো তো । আমার কাছে কিন্তু গান আছে ।
— তাই? আপনার গানের পয়েন্ট কত ম্যাম? আমার না খুব শখ ছোট বেলা থেকে গান চালাবো ।
— হেই ডোন্ট ইউ ডেয়ার । এগোবে তো গুলি চালিয়ে দেবো ।
— আচ্ছা দিন । দেখি তো আপনার টার্গেট কেমন ।
— আমি সত্যি বলছি গুলি চালিয়ে দেবো ।
— এত নাটক করতে আছে নাকি?
হুট করে মেয়ে টার হাত থেকে বন্দুক নিয়ে নিলো রাইদ ।
তারপর ওর হাত টেনে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো ।

আবছা আলোয় মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না তাই ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরলো রাইদ । লাইট জ্বালানো দরকার । নড়াচড়া করলেই ছুটে যাবে যেভাবে মোচড়াচ্ছে ।
মেয়েটা তার সর্বস্ব চেষ্টা করছে ছাড়া পাওয়ার । রাইদ শক্ত করে ওর দু’হাত চেপে ধরে হাতড়ে সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো ।
আলো মুখে পড়তেই বাঁকা হেসে বললো_
— আরে নীরা তুমি? চুরি করতে এসেছিলে বুঝি?
— বাস্টার্ড নাটক করিস! তুই জানিস আমি কে । আমার সামনে অভিনয় করবি না ।
— আরেহ্ বসের সাথে কেউ তুই তুকারি করে? তোমার দেখি একদমই ম্যানার্স নেই নীরা ।
— বস! তোর মত বাস্টার্ড হবে আমার বস? তুই জানিস আমি কে? আন্ডারওয়ার্ল্ড এর সাম্রাজ্ঞী আমি আর তুই নিজেকে আমার বস দাবী করিস?
— সাম্রাজ্ঞী! নীরা ওহ্ স্যরি স্যরি লিন্ডা আই থিংক কিছু তোমার মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং হচ্ছে । তোমার মা কে মারার পর সম্রাট তো আমি হয়েছিলাম বাট তোমাকে বিয়ে তো করিনি । তুমি সাম্রাজ্ঞী হলে কি করে?
— ভুল । তুই কখনোই সম্রাট না তুই একটা ধোঁকাবাজ , পা চাটা কুত্তা । এখনও তুই তাই আছিস । আমার মা কে ধোকাবাজি করে মেরেছিস তুই । মায়ের অবর্তমানে এখন সেই অধিকার আমার তোর নয় ।
— সেই অধিকার আদায় করতে বুঝি এসেছিলে?
— যে অধিকার কাউকে দেই ই নি সেটা আদায় করতে আসবো কেনো আমি তো এসেছি তোর কুকুরের মত মৃত্যু দেখতে ।
— লিন্ডা তো ধরা পড়ে গেলো তা’হলে আমাকে মারবে কে লিন্ডার ভাই?
উত্তর দিলো না লিন্ডা ।
লিন্ডার স্কার্ফ দিয়েই ওর হাত দু’টো শক্ত করে বাঁধলো রাইদ তারপর গলা উঁচিয়ে রফিক কে ডাকলো ।
রফিকও ঘাপটি মেরে নিচে বসে ছিল । সে ওপরে এসে নীরাকে দেখে আকাশ থেকে পড়লো যেন ।
তারমানে ও ই লিন্ডা? যার কথা রাইদ বলেছিলো ।
রাইদ , রফিককে দেখে স্রেফ ইশারা করে দিলো ।
রফিক তৎক্ষণাৎ কোথা থেকে রশি আর চেয়ার নিয়ে এসে লিন্ডা কে বেঁধে দিলো ।
রাইদ ওর মুখোমুখি বসে বেশ আয়েশ করে সিগারেট ধরালো ।
— আই মাস্ট সে তুমি খুব ভালো অভিনেত্রী লিন্ডা। এই যে এতদিন আমার সামনে পেছনো ঘুরেছো আমি বুঝতেই পারিনি ।
— তোর সামনে পেছনে ঘুরবো ওরকম খারাপ দিন আমার জীবনে আসেনি ।
— আহ্ রেগে যাচ্ছো কেনো? সেদিন কি সুন্দর আই লাভিউ বললে । আরেকবার বলো না গো?
— লাভ মাই ফুট । তোর মত কুকুরকে বউয়ের আঁচলের তলায় লেজ নাড়ানো মানায় ।
— ওকে মজা অনেক হয়েছে এবার সিরিয়াস আলাপে আসা যাক । আচ্ছা লিন্ডা তোমার ভাই টা যেন কে?
— তোর কি মনে হয় তুই আমাকে জিজ্ঞেস করবি আর আমি ইজিলি বলে দিবো?
— সেটাও কথা । এত ইজিলি তো তার মুখ দেখা যাবে না । তা’হলে কি তোমাকে মেরে দিবো? তোমাকে মারলে সে আমার সামনে আসবে?
— তুই কি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিস? লাভ নেই এই লিন্ডা মরতে ভয় পায় না । তবে একটা কথা শুনে নে তুই এখানে আমাকে মারবি ওখানে তোর বউ মরবে ।

রাইদ এবার নড়েচড়ে বসলো । লিন্ডার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো ও রাইদ কে ভয় দেখাচ্ছে নাকি সত্যি সত্যিই বলছে ।
লিন্ডাকে ডিটারমাইন্ড দেখে একটু থেমে গেলো রাইদ । যদি মিথির কাছে লোক পাঠানো থাকে তা’হলে ঝামেলা ।
রফিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো ওর দিকে একপলক তাকিয়ে ইশারা করতেই রফিক ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেলো । ও জানে এখন ওকে মিথিলাদের বাসায় যেতে হবে ।
এদিকে রফিক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় কেউ রাইদের ঘরের বেলকোণীতে এসে দাঁড়ালো ।
রাইদ আর লিন্ডার তখন তর্ক বিতর্ক চলছে । লিন্ডার একটা কথার প্রেক্ষিতে রাইদ গর্জে উঠে বলে_
— তোদের নির্বংশ না করে এই রাইদের মৃত্যু নেই ।
— তাই নাকি বন্ধু? এত কনফিডেন্স!
পুরুষালি গলা পেয়ে রাইদ ফিরে তাকায় । বেলকোণীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অতি পরিচিত একটা মুখ ।
হত বিস্ময়ে উঠে দাঁড়ায় রাইদ ।
— শব্দ?
— আরেহ্ বন্ধুর দেখি আমার নামখানা মনে আছে , এই না বেস্ট ফ্রেন্ড ।
ফিচেল হাসি শব্দ’র ঠোঁটের কোণে ।
__
অন্ধকার রুমে বসে আছে মিথিলা । চিন্তাশক্তি হারিয়েছে যেন নিজের , মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । আজ সত্যি মনে হচ্ছে নিয়তি তার সাথে বারংবার অকারণে অন্যায় করে যাচ্ছে ।
বাসায় গিয়ে অন্তর সহ ভিডিও গুলো ওপেন করে দেখেছে মিথি । ভিডিও ওপেন করাটাই ছিলো ওর জীবনের সবচাইতে বড় ভুল ।
আরেকবার স্বপ্ন ভঙ্গ , আরেকবার বিশ্বাস ভঙ্গ ।
ভাবতেই অবাক লাগছে মানুষটা কি নিখুঁত অভিনয় জানে । যে হাত দিয়ে মিথির বাবা কে মেরেছে , বাগদত্তা কে মেরেছে সেই হাত দিয়ে কাছে টেনেছে । এই শরীর ছুঁয়েছে , ভালোবাসা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অথচ সে তো ভালোই বাসেনি । না ভালোবাসা দেবার সামর্থ্য আছে তার আর না ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার ।
ব্যাস অনেক হয়েছে অন্যায় । আজ এই সব কিছুর ইতি টানতে হবে ।
চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায় মিথি । দূর্বল পা জোড়া টেনে আলমারির সামনে এসে লাল জামদানি টা বের করে । আজ শেষ বারের মত তাকে স্বামী বলে মেনে নেবে,রঙিন কাপড় গায়ে চড়াবে মিথি । যদিও আজ রাইদের ফেরার কথা ছিলো না কিন্তু রফিক আসার পর ওর দ্বারা সংবাদ পাঠিয়েছে রাইদ যাতে অবশ্যই আসে , মিথিলা অপেক্ষা করবে তার জন্য ।

রাইদের অনুপস্থিতিতে ঠিক ওর মন মত সাজে । সারা ঘর খুব যত্ন করে সাজিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে ওর জন্য ।
রফিক এসে দেখে পুরো ঘর রক্তে মাখামাখি । লিন্ডা আর শব্দ এক দিকে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায় , রাইদ সোফায় বসে এখনো সিগারেট ফুঁকছে । ওর পেছনে একটা সারিতে অস্ত্র ধারী কয়েকজন ছেলেপেলে দাঁড়িয়ে ।
রফিককে দেখে রাইদ আঙ্গুলে ইশারা করে বলে_
— দেখো রফিক আজ অন্ধকার জগত কে নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছি ।
— স্যার শব্দ স্যারও এদের সাথে ছিলো?
— হ্যাঁ ও ই তো মাস্টারমাইন্ড । ও শিহান এহসানের ছেলে নয় ও তো আলিজার ছেলে । মায়ের হত্যার প্রতিশোধ আর ডায়মণ্ডের জন্য এসেছিল ।
— তা’হলে সে ম্যামের সাথে বিয়ের নাটক করছিল?
— ইয়েস । তোমার ম্যামের বাবা মৃত্যুর পূর্বে মেয়ে জামাইয়ের জন্য ডায়মণ্ডগুলো রেখে গেছিলো উপহার স্বরূপ । এগুলো কোটি টাকার সম্পদ ।
এর লোভ সামলাতে পারেনি বাস্টার্ড গুলো । ওদের ফ্যামিলি সম্পর্কে সকল ইনফরমেশন নিয়ে শিহান এহসানের ছেলে সেজে এসেছিলো ।
আমার সাথে বন্ধুত্ব তো করেছিলো ওর মায়ের মৃত্যুর পর । দেখেছো আমি বুঝতেও পারিনি ।
— স্যার এরা আপনার টিমের ছেলে?
পেছনে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিকে ইশারা করে দেখালো ।
— হু
— কিন্তু স্যার আপনি তো বলেছিলেন..
— টাকা ছেটালে সব সম্ভব রফিক । ওদের আমি ফের কিনে নিয়েছি মুক্ত করার জন্য । আজ থেকে ওরা সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র৷
রাইদের কথা শেষ হতেই ছেলেগুলো শব্দ আর লিন্ডার লাশ তুলে নিয়ে চলে গেলো ।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তগুলোর দিকে তাকিয়ে রফিক বললো_
— স্যার ওরা যদি আবার বেঈমানী করে?
— কেউ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে চায়?
— স্যার আপনি বললেন অন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসবেন ।
— বেরিয়ে আসবো কিন্তু আমার পার্সোনালিটি কি চেইঞ্জ হবে?
রফিক বুঝে গেলো রাইদের ক্ষমতা কিংবা অভ্যাস একটারও হয়তো পরিবর্তন হবে না । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ও বললো_
— স্যার ম্যাম আপনাকে ফার্ম হাউজে যেতে বলেছে ।
— মানে? তোমার ম্যাম এত রাতে ফার্ম হাউজে কি করছে? সে একা গেছে?
— আমি রেখে এসেছিলাম যাতে এনারা কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
— আচ্ছা রফিক তুমি ঘরটা ক্লিন করে ফেলো আমি এক্ষুণি যাচ্ছি ।
— আচ্ছা স্যার ।

ফার্ম হাউজে পৌঁছায় রাত তিনটের দিকে ।
সারা বাড়ি তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ।
একটু অবাক লাগে কারণ মিথির অন্ধকারে থাকার অভ্যাস নেই । ফোনের ফ্ল্যাশের আলোয় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আর মিথির নাম ধরে ডাকতে থাকে ।
ঘরের সামনে আসতেই তাজা রজনীগন্ধার সুবাস নাকে আসে ।
ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে ঘরের ভেতর ঢুকতেই অবাক হয়ে যায়।
সবুজ ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় সাজানো ঘরটা অপরূপ লাগে । তার থেকেও অপরূপ , মোহনীয় দৃশ্য সামনে । তার প্রিয়তমা এতদিনে তার পছন্দের সাজে সজ্জিত করেছে নিজেকে ।
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ও মিথির সামনে ।
একহাত বাড়িয়ে গ্রীবা স্পর্শ করে আলতো ভাবে ।
ঠান্ডা হাতের স্পর্শে খানিকটা কেঁপে ওঠে মিথি । ফিসফিস করে প্রশ্ন করে_
— রফিক ভাই কে পাঠিয়েছিলে কেনো? আমায় একা ফার্ম হাউজে রেখে গেলো ।
— আমি পাঠিয়েছিলাম তুমি একা আছো বলে ।
— আর সে আমায় রেখে গেলো ফার্ম হাউজে?
— আমি তো আসতামই এখানে ।
–আচ্ছা ,এত দেরি হলো কেনো ফিরতে?
— একটু কাজ ছিলো বাইরে ।
— আমায় কেমন লাগছে?
— অপরূপ । তোমার রূপের নেশা তো ভয়ানক ।
— আজ এই নেশায় ডুবিয়ে মারবো তোমায় ।
— মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে শুধু শুনতে চাই ভালোবাসো আমাকে?
— ভালোবাসবো ।
— যেই মুহুর্ত থেকে ভালোবাসবে ঐ মুহুর্তে তোমার নেশায় ডুববো আমি ।
— রাইদ আমার তোমাকে চাই , খুব করে ।
— মিথি , রাইদের ভালোবাসা চাই । সারাটা জীবন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তড়পেছি আমি ।
— আমার এই দু চোখে কি ভালোবাসা দেখতে পাও না?
— বুঝতে পারছি না । নেশা ধরিয়ে দিলে কি?
মিথি একটু হেসে দু কদম এগিয়ে আসলো একদম রাইদের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো_
— রাইদ আমি তোমাকে ভালোবাসি । অনেক ভালোবাসি ।
ব্যাস এটা শোনা মাত্র রাইদ ওকে বুকে জড়িয়ে নেয় । শূন্য বুকটা ভরে ওঠে যেন!
এদিকে রাইদের কাঁধে মাথা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিথিলা ।
দু চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরে যায় ।
সেই রাতে রাইদ তার প্রিয়তমাকে সর্বস্ব দিয়ে কাছে টেনে নেয় , আজ ওর জীবনের সবচাইতে খুশির দিন ।
ভোর পাঁচটা,

আজানের মধুর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে ।
মিথির সাথে রাইদও উঠেছে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়বে বলে । আজ থেকে সব কিছু নতুন করে শুরু করবে ও । সব পাপ কাজ ছেড়ে দিবে । পরিকল্পনা করেছে এই দেশ ছেড়েই চলে যাবে , অন্য কোথাও গিয়ে নতুন সংসার শুরু করবে ।
মিথির বারবার চোখ ভিজে আসছে । সব ভুলে রাইদ কে মেনে নিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু একজন নিরপরাধ মানুষকে ও খুন করেছে এর শাস্তি তো প্রাপ্য ।
ঘৃণার দেয়াল ছাপিয়ে ভালোবাসা ফুটতে চাইছে মনে ।
অন্তর্দ্বন্দ্ব কাটাতেই নামাজের পাটিতে দাঁড়ায় মিথি । রাইদ শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে নামাজ পড়ছে মিথিলা ।
আলমারি থেকে বাবা’র দেয়া জায়নামাজ টা বের করে বুকে জড়িয়ে ভাবে প্রায় দশ বছর পর আজ নামাজের পাটিতে দাঁড়াবে ভাবতেই চোখের কোণে জল চলে আসে ।
নামাজ পড়ে মিথি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় । কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি তে আলো ফোটেনি তেমন , তবুও হিমেল হাওয়া স্নিগ্ধ লাগে । প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সমস্ত শরীর বিষিয়ে আছে যেন । নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিজের কাছে বিরক্ত লাগে । চোখ দিয়ে পানি আসতে চায় কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় ।
রাইদ নামাজ পড়ে উঠে ভাবে মিথি কে সব খুলে বলবে কিছুই লুকোবে না ।
ও নিশ্চয়ই সব শুনে আবার রেগে যাবে কিন্তু ওর রাগ সামলে নিবে ঠিক ।
মনস্থির করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় । মিথির কাঁধে হাত দিয়ে আলতো স্বরে ডাকে ।
— মিথি?
— হু
— কি করছিলে?
— বাইরে টা দেখছি ।
— ওহ্
— কিছু বলবা?
— হু আসলে..
— তোমার জন্য চা নিয়ে আসি একটু বসো । চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে না’হয়?
— ঠিকাছে ।

দরজার কাছে যেতে রাইদ আবার ডেকে ওঠে_
— মিথি একটা জিনিস খেয়াল করেছো? তুমি কিন্তু কাল রাত থেকে আমায় তুমি সম্বোধন করে ডাকছো ।
উত্তরে ফিকে হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় মিথিলা ।
রাইদ রেলিংয়ে ভর দিয়ে ভাবতে থাকে আসলেই সবটা বলবে? বলা কি ঠিক হবে? পূর্বের কথা মনে পড়ে, মিথি বলেছিল এটাই শেষ সুযোগ ।
নাহ্ পুনরায় চিন্তা করা দরকার । আগেই বলাটা ঠিক হবে না আর বলবেই বা কি? ও দু’টো মানুষ কে খুন করেছে , ও একটা খুনি? শব্দর ব্যাপারে কিছুই জানেনা মিথি ওকে জানানোর দরকার নেই তারচেয়ে ।
সব ধামাচাপা দিক । সম্পর্ক বাঁচানোর খাতিরে সবটা লুকোনো থাক ।
কিছুক্ষণ পর চা’য়ের কাপ নিয়ে হাজির হয় মিথিলা । রাইদ মুচকি হাসি দিয়ে থ্যাংক্স বলে ।
দু’জনে চুপচাপ চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে যায় । বাইরে পাখপাখালি কিচিরমিচির করছে ।
অর্ধেকটা চা খাবার পর রাইদের হঠাৎ মাথাটা ঘোরাতে থাকে , ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না ভেবে আমলে নেয় না । এক চুমুকে চা টা শেষ করে মিথিকে বলে_
— চলো শুয়ে পড়ি । খুব খাটুনি গেছে এই সাতদিন । এখন একটু ঘুমানোর প্রয়োজন৷
মিথি সম্মতি দিয়ে চা’য়ের কাপটা হাতে নেয় ।
রেখে আসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় । রাইদের মাথা ঘোরানো বেড়ে যায় । চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে , হাত বাড়িয়ে মিথিকে ডাকে , মিথি ফিরে তাকিয়ে স্থির হয় দাঁড়িয়ে থাকে ।
রাইদ টলমল পায়ে এগুনোর চেষ্টা করতেই হুড়মুড় করে পড়ে যায় আর সাথেসাথে মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে ।
ও বুঝতে পারে সবটা । চোখ বন্ধ করার মুহুর্তে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে_
— ও আমায় ভালোবাসেনি