একঝাঁক জোনাকির আলো

একঝাঁক জোনাকির আলো !! Part 50

৫০.
___________________
সাফা বসে আছে অভ্রর সামনে।ভয় ভিতী আর এক অজানা জড়তা কাজ করছে সাফার মাঝে।অভ্রর ফিলিংস জানার পরে সাফার আর আগের মত অভ্রর সাথে ফ্রি ভাব আসে না।আগে যেমন মজা আর হুল্লুর করতে ইচ্ছে হত তা এখন আর করে না।অভ্র আজ সকাল সকালই সাফাকে তার সাথে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলেছে।তখন থেকেই সাফার হাঁসফাঁস লাগছে।সব জানার পরে সাফা সেভাবে অভ্রর মুখামুখি হয় নি।নিভ্র সব জানার পরে কখনই সাফাকে বা অভ্রকে এসব নিয়ে কিছু বলে নি।কিন্তু আজ এভাবে সামনাসামনি বসে থাকতে সাফার প্রচন্ড জড়োতা কাজ করছে।সাথে এক অদ্ভুত অনুভুতি।আগের মত হেঁসে হেঁসে চোখে চোখ করে কথা বলতে পারছে না কেউই।সাফা নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাচ্ছে।আর অভ্র পাশের কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ভাবছে কিভাবে কথা শুরু করবে।কিন্তু কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।ছাত্রী স্যারের সেই সম্পর্কও এখন আর তাদের মাঝে নেই।তার সাথে আবার…. তাই কেনো যেনো অসস্তি হচ্ছে।অনেকসময় নিয়ে দুজনেই চুপ করে নিজেদের জায়গায় বসে ছিলো।অভ্র পাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে বললো,
—” কেমন আছো সাফা??”
সাফা চমকে তাকালো।হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করেছে যে সে হকচকিয়ে গেলো।ভালো করে বুঝতেও পারলো না।তাই বললো,
—” স্যরি স্যার বুঝলাম না।”
অভ্র সোজা হয়ে সাফার বরাবর বসল।তারপর আবার বললো,
—” কেমন আছো জিজ্ঞেস করেছি??”
সাফা মিনমিনে গলায় বললো,
—” ভালো স্যার।”
দীর্ঘ করে কিছু নিঃশ্বাস ফেলে অভ্র বললো,
—” দেখো যা হওয়ার হয়েগেছে। আমি তেমন ভণিতা করে কথা বলতে পারিনা।আমি আর নিভ্র এক কথায় সমবয়সী টাইপের।ওকে আমি নিজের বোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসী।ওর প্রতি ভালোবাসার আমার কাছে কোনো বর্ণনা নেই।আর তুমি…
কথাটা বলেই অভ্র থামলো।গলায় কেমন যেনো আঁটকে আছে কথাটা।সাফা এবার আগ্রহের সাথে মনোযোগী হলো।নিভ্র একটু থেমে বললো,
—” তোমার প্রতি আমার যে ফিলিংস আছে তা একান্ত নিজের।আমি চাইনা এগুলো নিয়ে নিভ্র কখনোই কষ্ট পাক।ব্যাপারটা নিভ্রর সাথে জড়িত না হলে আমি কখনোই হয় তো তোমাকে আলাদা ভাবে দেখার চেষ্টা করতাম না।নিভ্র আমার কাছে সব কিছুর উর্ধ্বে। ওর সব কিছু আজীবন আমাকে দিয়ে এসেছি।তাই আমি ওর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসে কখনোই চোখ দিতে চাই না।কিন্তু সবই ভাগ্য।ভালোবাসা বলে আসেনা কথাটা কতটুকু সত্য তা আমি বুঝে গেছি।তাই এতে আমার হাত নেই।কিন্তু তবুও আমি দুঃখীত তোমাদের এত দিনের দূরত্বের জন্য।শত হোক আমি কিছুটা হলেও দায়ি।”
সাফা চট করেই বললো,
—” না স্যার।আমিও দোষি।ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে আসা আমার উঁচিত হয়নি।”
নিভ্র নিচে থেকে চোখ তুলে সাফার দিকে একবার তাকায়।মুচকি হেঁসে বলে,
—” নিভ্রকে খুব ভালোবাসো না??”
সাফা আমার অপ্রস্তুত হয়ে পরে।মাথা নামিয়ে নেয়।অভ্র হাঁসে। তারপর বলে,
—” ওকে সব সময় এভাবেই ভালোবাসবে।তোমাকে এতটাই ভালোবাসেছি যে নিভ্র না থাকলে আমি সত্যি তোমাকে ছাড়তাম না।হ্যা নির্লজ্জ মনে হতেই পারে তবে এটাই সত্য।শুধু নিভ্রর সাফা বলেই অভ্র পিছিয়ে এসেছে।আমি তোমাকে ছাড়া বেচেঁ থাকতে পারবো।কষ্ট একটু হবেই।সবাই বিরহে কাতর হয়।আমিও হয়েছি আরো হবো।কিন্তু নিভ্র??সে তোমাকে ছাড়া বাচঁবে না।তোমাকে ছাড়া ওর নিঃশ্বাস বন্ধের মত অবস্থা হয়।আমি কখনোই চাই না নিভ্রর জীবনে আবার কখনো এমন পরিস্থিত আসুক।তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কিছু বছরের।কিন্তু নিভ্রর প্রতি তা যুগের।তাই ওকে আমি খুবই ভালোবাসি।ও নিজেও আমাকে অনেক ভালোবাসে।যদিও মুখে শিকার করে না।আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের মাঝে কখনো কোনো সমস্যা হোক।”
অভ্র থামলো।টেবিলের উপড়ের পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি এক নিমিষে খেয়ে নিলো।সাফা শুধু অবাক হয়ে ভাবছে।এত ভালোবাসা এদের দুই ভাইয়ের মাঝে যা তাকে ক্রমশ অবাক করে।নিভ্র জানে অভ্রর ফিলিংসের কথা অভ্রও যানে তাদের কথা।কিন্তু এ নিয়ে তাদের দু’জনের কোনো মাথা ব্যথা নেই।যে যার মত।এমনকি অভ্র যখন তাকে দেখা করতে বলেছে তখন নিভ্র তার সামনেই ছিলো। তাকে বলতেই সে সাফাকে রেস্টুরেন্টে দিয়ে গেলো।কোনো রাগ হলো না।কত গভীর তাদের ভালোবাসা কত বিশ্বাস একের প্রতি অপরের।সাফা শুধু অবাক হয়ে সব দেখে।যখন গল্প করতে বসে সাফা অসস্তিতে পরে।দূরে বসে থাকে কিন্তু নিভ্র আর অভ্র বিন্দাস গল্প করে মজা করে একে অপরকে নানা কথা দিয়ে খোঁচায়।সাফা তো এমন অনেক ভাইয়েদের দেখেছে এক ভাই আর এক ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডকে জোড় করে বিয়ে করে।ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডকে নিজের বউ করে।ভাইকে ধোঁকা দেয়।মারামারি করে।আবার যখন কেউ জানতে পারে তার বউকে বা তার গার্লফ্রেন্ডকে তার নিজের ভাইও পছন্দ করে তখন সম্পর্কে কত সন্দেহ কত ঝগড়া কত কিছু হয়।কিন্তু অভ্র আর নিভ্র সবার থেকে আলাদা। এদের আসলেই তুলোনা হয় না।অভ্র ভিতর থেকে কিছু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বললো,
—” দেখো এখন কিন্তু আমি তোমার ভাশুর হবো তোমার জামায় থেকে আমি ছয় মাসের বড়।তাই ভুলেও আমাকে মার্বেল দিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে না।”
সাফা হেঁসে দেয়।অভ্র মাথা নিচু করে হাঁসে। সাফার হাসি সে দেখবে না।এটা তো নিভ্রর। তারই দেখার অধীকার।সাফার প্রতি ফিলিংসকে তো সে মারতে পারবে না।কিন্তু দুজনের মাঝে আলাদা সম্পর্ক তৈরি করা তো যেতেই পারে।তাই সাফার সাথে কথা বলা।সাফা অভ্রকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে চুপ করে যায়।অভ্র সাফাকে বললো,
—” তা কি খাবে বলো??”
—” খাবো না কিছু।”
—” আরে তা বললে হবে না।আমি কিন্তু তোমার বড় ভাশুর।আমার কথা তো শুনতেই হবে।”
সাফা হাঁসে। অভ্র ওয়েটারকে কিছু খাবার আর কফি দিতে বলে।
—” তা লেখাপড়া কেমন চলে??”
সাফা নিচু স্বরে বলে,
—” ভালো।”
—” এখনো ইংলিশকে ভয় পাও??”
সাফা রাগি চোখে তাকায়।তেজি গলায় বলে,
—” মোটেও না।আমি কখনোই ইংলিশকে ভয় পাই না।”
অভ্র ভারী অবাক হওয়ার মত বললো,
—” তাই!!”
—” হুম।আচ্ছা আপনারা দুই ভাই এমন ঘাসপুস নিয়ে পড়ালেখা কেনো করলেন বলেন তো??একজন ডাক্তার আর একজন ইংলিশের প্রফেসার।আপনাদের জন্য কি দেশে সাবজেক্টের অভাব পড়েছে নাকি??হুহ।”
অভ্র শব্দ করে হেঁসে ফেলে।মনে মনে খুশি হয়।সাফা আগের মত তার সাথে ফ্রি হতে পেরেছে এটাই অনেক।সে এটাই চেয়েছে তাই সাফার সাথে কথা বলতে চেয়েছে।অভ্র বললো,
—” তোমার কাছে ঘাসপুস মনে হয় কেনো??তুমি তো ইংলিশকে ভয় পাও না।”
অভ্র হাঁসে। সাফা রাগে কটমট করে মুখ বাঁকায়।
______________
বাহিরে এসে অভ্র সাফাকে তার বাসায় নামিয়ে দিতে চায়।কিন্তু সাফার নাকি কাজ আছে।অভ্র সেখানেও দিয়ে আসতে চেয়েছে।সাফা না করেছে।অভ্র কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে আসে।তারপর বলে,
—” আমি চাই আমাদের সম্পর্কটা এমনই থাকুক আগের মত।তা না হলে নিজের কাছেই খুব অসস্থি লাগবে।আশা করি তুমি বুঝেছ।”
সাফা মুচকি হেঁসে মাথা নাড়ে যার অর্থ সে বুঝেছে।অভ্র আবার কিছু দূর যেতেই সাফা ডাকে।অভ্র পিছিয়ে আসে।সাফার দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডান হাতে চশমা ঠিক করে।সাফা শীতল কন্ঠে বললো,
—” পৃথিবীতে সকল নারী পুরুষের জন্য আল্লাহ জুটি তৈরি করে পাঠায়।আমি শুনেছি ছেলেদের পাঁজরের হাড় দিয়ে তাদের জীবন সঙ্গীকে তৈরি করেছে।আমরা যে যাকেই পছন্দ করি„ ভালোবাসি„ বা পেতে চাই না কেনো!!পাবো না।যদি তিনি না চায়।আপনার জন্যও এমন কাউকে আল্লাহ বানিয়ে রেখেছে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।সেও আপনার জীবনে ঠিক সময়ে চলে আসবে।যাকে আপনার পাঁজর দিয়ে বানিয়েছে সে আসবেই। আজ না হয় কাল।কিন্তু আপনার জিনিস আপনারই থাকবে।আপনি নিজেই পাঁজরের সন্ধানে তার কাছে চলে যাবেন।হয় তো সে চলে আসবে।কিন্তু আসবে নিশ্চিত। তাই আপনিও জমিয়ে রাখুন।লুকিয়ে রাখুন।সব ভালোবাসা গোপনে রাখুন।সে যখন আসবে তখন যেনো আপনি শূন্য হাতে না থাকেন।তাকে যাতে উজাড় করে দেওয়ার মত বুক ভর্তি ভালোবাসা আপনার থাকে।
অভ্র গভীর মনোযোগী হয়ে সাফার কথা গুলো শুনলো।তারপর বললো,
—” দু’জনকে কি একজীবনে ভালোবাসা যায়??”
সাফা হেঁসে বললো,
—” হুম যায়।আপনি হয় তো আগের জনের মত করে পরের জনকে ভালোবাসতে পারবেন না কিন্তু হয় তাকে আগের জনের চাইতে বেশি বা কম বাসতে পারবেন।আর দ্বিতীয় কেউ যখন আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভালোবাসা হয়ে আসে তখন বুঝবেন আগের জনের চাইতে আপনি তাকেই বেশি ভালোবাসেন।আগের জনকে যদি আপনি বেশি ভালোবাসতেন হলে দ্বিতীয়জন আপনার কাছে অধীক গুরুত্বপূর্ণ হত না।আশি।”
অভ্র মোড় ঘুড়িয়ে গাড়িতে বসে।সাফার চোখের সামনে থেকে তার পালাতে ইচ্ছে করছে তাই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এখান থেকে সরে যায়।
________________________
সাফা রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে।তার নিজেকে খুব হালকা লাগছে।কাউকে কষ্ট দিয়ে সর্বোচ্চ সুখ পাওয়া যায় না।সাফার মনেও একটা ভীতি ছিলো।কিন্তু অভ্রর সাথে কথা বলে এখন ঠিক লাগছে।রাস্তার পাশেই একটা পার্ক।পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে শুনে একটা মেয়ে বলছে,
—” আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
সাফা চট করেই তাকালো।মেয়েটা ছেলেটার কাধে মাথা দিয়ে আছে।চেহারা দেখা যাচ্ছে না।সাফা হঠাৎ করেই এই কথাটা নিভ্রকে বলতে ইচ্ছে হলো।সাফা ফোন বের করলো।নিভ্রর ফোনে কল দিলো।নিভ্র সাফারানী লেখা দেখেই অবাক।সাফা এই প্রথম তাকে কল করেছে।নিভ্র চিন্তিত হয়ে কল রিসিভ করে বললো,
—” তুমি ঠিক আছো সাফা??”
—” হুম ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে আপনার এত চিন্তা কিসের বলেন তো??এত চিন্তা করেন কেনো??”
—” এমনেই।তা আজ কি সূর্য নিজের গতি পথ পাল্টেছে নাকি??”
সাফা লাজুক হেঁসে বললো,
—” না।”
নিভ্র যেনো ও পাশ থেকেই বুঝতে পেরেছে।তাই বললো,
—” বাহ আজ দেখি লজ্জাও পাওয়া হচ্ছে। কেনো?? কেনো??বলো??”
সাফা কিছুসময় চুপ করে থাকে।নিভ্রর বুক হঠাৎই ধুকপুক ধুকপুক করে।সাফার চলন্ত নিঃশ্বাসের শব্দ তার কানে এসে লাগছে।সাফা ঠান্ডা গলায় নিচু স্বরে বললো,
—” মিস্টার ভিলেন!!”
নিভ্র কান খাড়া করে।অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে তার।সাফা আবার বললো,
—” মিস্টার মডেল-ফডেল!!”
নিভ্র নিঃশব্দে হাঁসে। সাফা অনেক সময় চুপ করে থাকে।কিছু নিঃশ্বাস ফেলে সাফা বললো,
—” আমি আপনাকে ভালোবাসি ডাক্তার।”
নিভ্র বসা থাকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।তার কান যেনো স্তব্ধ হয়েগেছে। সে ভাবতেই পারছে না সাফা নিজের মুখে এটা বলছে।নিভ্র বুক কাঁপে।খুশিতে উত্তেজনায়।কি বলবে খুঁজে পায় না।সাফা মুখ টিপে হাঁসে। তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।দুজনেই চুপ করে আছে।নিভ্র বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাফার কান গরম হয়ে উঠে।লাল হয় গাল।প্রথম ভালোবাসি বলার ফিলিংসটাই অন্যরকম। তার মনে হচ্ছে এটা এক কাঁপানো ফিলিংস।
সাফা ফোন কানেই রাস্তার পাশে দিয়ে হাঁটছে। আশেপাশের কিছুই তার নজরে পরছে না।নিভ্রর দ্রুত গতির নিঃশ্বাস সে নিঃশব্দে গুনছে।রাস্তার পাশ দিয়েই দ্রুত একটা বাইক সাফার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাফাকে প্রচন্ড জোড়ে ধাক্কা দিয়ে এক পাশে ফেলে দেয়।সাফা ছিটকে রাস্তার পাশে পড়ে যায়।তার মাথা ফেঁটে টিপ টিপ করে রক্ত বের হচ্ছে। এক পাশ নাড়াতে পারছে না।সব কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে।মানুষের ভিড় জমে যায় সাফাকে ঘিড়ে।তার পাশেই ফোনটা পরে গেছে।সাফার চোখবুজে আসছে।সব ধোয়াঁশা লাগছে।মানুষের গিজগিজ শব্দ তার মাথায় আরো আঘাত করছে। মনে হচ্ছে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে সবার তৈরি শব্দে।
নিভ্র সাফাকে অনেক সময় নিয়ে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু সাফার কোনো শব্দ আসছে না।উল্টা মানুষের শব্দ আসছে।নিভ্রর বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে।ভয়ে তার প্রান উবে যাচ্ছে। নিভ্র চেঁচিয়ে ডাকছে।কিন্তু সাফার একটা শব্দও শুনতে পাচ্ছে না।হঠাৎ কেউ ফোনটা ধরে বললো,
—” আপনি এই মেয়ের বাড়ির কেউ??”
নিভ্র বিস্ময়ে হতভম্ভ। কিছু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।লোকটা আবার বললো,
—” আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দেন??”
নিভ্র দ্রুত ধরা গলায় বললো,
—” হ্যাঁ। ও ঠিক আছে তো??কি হয়েছে?? আপনি কেনো ফোন ধরলেন??ওকে দেন!!”
—” উনি ধরার পরিস্থিতিতে থাকলে তো ধরবে??এক্সিডেন্ট হয়েছে তাও বাইক।মাথা ফেঁটে গেছে।অবস্থা খারাপ।বুঝিনা বাপু এত জোড়ে বাইক চালানোরই বা কি আছে আর ফোনে কথা বলে রাস্তা দিয়ে হাটাঁরই বা কি আছে।যে সব রাস্তা দিয়ে অনেক গাড়ি চলে সে সব রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা না বললে হয় না।আজ কালকার পোলাপাইন। এদের বলেও লাভ নাই।”
লোকটা নিজের মত বকবক করেই চলেছে কিন্তু যাকে বলছে সে অলরেডি ফ্লোরে বসে পরেছে।নিভ্রর সারা শরীর কাপঁছে।সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।উঠে দাড়াঁতে পারছে না।কাউকে ডাকতেও পারছে না।নিভ্রর সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।অভ্র মাত্র বাসায় এসেছে।নিজের রুমের দিকে যাওয়ার সময় নিভ্রর রুমে চোখ যায়।অভ্রর চোখ কপালে।হলো কি??দৌড়ে নিভ্রর কাছে গেলো।নিভ্রর শরীর কাপঁছে। অভ্র ঝাঁকালো।প্রশ্ন করলো,
—” নিভ্র কি হয়েছে?? নিভ্র??”
নিভ্র অঙ্গুল উঁচিয়ে মোবাইল দেখিয়ে দেয়।অভ্র দ্রুত ফোন কানে নেয়।নিভ্র বিছানায় ভর দিয়ে উঠে দাড়ায়।পায়ের সেন্ডেল আগেই খুলে গেছে।এভাবেই রুম থেকে বেরিয়ে পরে।তার মাথা কাজ করছে না।অভ্র ফোন কানে নিয়েই বুঝতে পেরেছে কি হয়েছে।ভয়ে তারও হাত পা কাপঁছে। মনে হচ্ছে আবার একবার সে ভুল করলো।সাফাকে নিজে নিয়ে আসলে কি এমন হতো??অভ্র সাফাকে যে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে সেটার ঠিকানা নিলো।নিজের চুল অভ্র নিজেই টেনে ধরে।সে এত বড় ভুল আবার কেনো করলো??সাফার যদি কিছু হয় অভ্র নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করবে??আর নিভ্র??অভ্র দ্রুত দৌড় দেয়।নিভ্রর মাথা ঠিক নেই না জানি কি করে??
নিভ্র হাঁটতে পারছে না।তার শরীর কাপঁছে। সিঁড়িতেই নিভ্র বসে পরে।অভ্র দ্রুত নিভ্রকে ধরে।গাড়িতে নিয়ে যায়।নিভ্রর অবস্থা ভায়াবহ।সে বুক চেঁপে বসে আছে।কাপঁছে, বুক ধুকধুক করে।নিভ্র চোখে পানি।মুখে আতংক।অভ্র দ্রুত ড্রাইভ করছে।অনেক ট্রাফিক সিগনাল ভেঙেই অভ্র হসপিটালে পৌছালো।ঘন্টা খানেক লেগেছে পৌছাতে।সে মনে প্রানে দোয়া করছে সাফার যেনো বেশি কিছু না হয়।নিভ্র হসপিটালে এসেই দৌড়ে ভিতরে ডুকে।এত সময়ের সব শক্তি যেনো হঠাৎ করেই বেরে গেছে।তার মাথা ঘুড়ছে।দৌড়ে সামনে গিয়ে যাকে পাচ্ছে ধরে প্রশ্ন করে সাফার কোথায়??কয়েক জন এগিয়ে এসে বললো,
—” ওই তো ওই ওয়ার্ডে আছে সেই মেয়েটা।আর এটা ওর ব্যগ আর ফোন।”
নিভ্র নিলো না।দৌড়ে সেদিকে গেলো।ডাক্তার মাত্র বের হয়েছে।নিভ্র কাপাঁ গলায় প্রশ্ন করে,
—” সাফা, ও ঠিক আছে??”
—” সাফা কে??”ডাক্তার বললো।
—” যে মেয়েটাকে কিছুক্ষণ আগে এনেছে।এক্সিডেন্ট হয়েছে ওর।ও ঠিক আছে??বেশি ব্যথা পেয়েছে??কতটুকু পেয়েছে??খুব লেগেছে না??আচ্ছা ওকে ইনজেকশন দিবেন না আমি নিজে দিবো।ও ভয় পায় এগুলো।আরে আপনি কিছু বলছেন না কেনো??”
—” আপনি বলতে দিলো তো বলবো??”
—” বলেন না প্লিজজজ দ্রুত!!”
ডাক্তার অবাক নিভ্রর উম্মাদিপনা দেখে।নিজেকে সামলে বললো,
—” ডান হাত আর ডান পা ভেঙে গেছে।আর মাথা ফেটে রক্তক্ষরন হয়েছে।তবে ডেঞ্জারাস ব্যাপার না।বাইক পাশ থেকে মেরেছে তা না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি ছিলো।এখনো বেডে দেওয়া হয় নি।সব ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে নার্সরা।আপনি মি.নিভ্রনীল তাই তো??”
নিভ্র কেবিনে উঁকি দিয়ে দেখে।নার্সরা পায়ে প্লাস্টার করছে।নিভ্র সব শক্তি হারিয়ে পাশের বেঞ্চে বসে পরে।খুব ক্লান্ত লাগছে।ভয়ে তার সব কেমন এলোমেলো হয়েগেছিলো।তারপর বলে,
—” হুম।”
—” পেসেন্ট আপনার কি হয়??”
নিভ্র নির্বিঘ্নে বললো,
—” বউ।”
—” ওও।”
ডাক্তার নিভ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে হালকা হাঁসে। তারপর সামনে চলে যায়।অভ্র নিভ্রর পাশে বসে পরে।বাসার কাউকে বলা হয় নি তাই ফোন করে সবাইকে আসতে বলছে।আর সাফার বাবাকেও।এত ভয় পেয়েছিলো যে মাথাই কাজ করছিলো না।অভ্র সিটে হেলান দিয়ে বসে।নিভ্রর এখনো শরীর কাপঁছে।নিভ্রর মনে হচ্ছে সাফাকে এভাবে ঘুড়তে দেওয়া মানে নিজের প্রান হাতে নিয়ে বসে থাকা।না এটা আর সে করবে না।ভাগ্য বার বার তাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে মানে এই না যে সব সময় দিবে।আজই সাফার বাবাকে বলবে সাফা তার সাথে তাদের বাড়িতেই থাকবে।প্রচন্ড ভয় পেয়েছে আজ।মনে হচ্ছে প্রান যায় যায়।
______________________
বাসার সবাই এসে অবাক হয়েছে সব শুনে।সবাই সাফাকে দেখি নেয়।সাফার জ্ঞান ফিরেনি।নিভ্র ডুকার কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরে।নিভ্র কেবিনে ডুকেই দেখে সাফা ঠোঁট উল্টে কাদঁছে। পা দেখছে হাত দেখছে।নিভ্র ধপ করে নিচে বসে পরে।শব্দ করে মুখ ঢেকে হাঁসে। সাফা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।নিভ্রর তো কাঁদার কথা সে হাসছে কেনো??সাফা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে আবার কান্নায় মন দেয়।ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে সে কাদঁছে। নার্স ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে নিভ্রকে দেখছে।এত হাসির কি হলো??রোগী দেখতে এসে কেউ হাঁসে নাকি??নিভ্রকে দেখে সাফা কাদঁতে কাদঁতে বললো,
—” আপনার সমস্যা কি?? হাসেন কেনো??আমার পা!!আমার হাত!!! আমি এখন কিভাবে খাবো??কিভাবে হাটঁবো??”
নিভ্র উঠে দাঁড়ায়। হাঁসতে হাঁসতে সাফার সামনে এসে দাঁড়ায়। সাফা তাকিয়ে দেখে।নিভ্রর চোখে পানি চিকচিক করছে।গালে পানির দাগ শুকিয়ে গেছে।তবুও সে হাসছে।নিভ্র টুল টেনে বসে।তারপর বললো,
—” এতদিন আমি ভাবছিলাম তুমি হয় তো সিরিয়েস হয়েগেছো।কিন্তু না সাফা আর সিরিয়েস?? ইম্পসিবল। তুমি এত দিন হাত পা কাটঁতে এবার একদম ভেঙেই ফেললে??বাহ্। এটাই পুরোনো সাফার রূপ।খুবই ভালো।কিন্তু এক পা আর এক হাত কেনো ভাঙ্গলে?? আর একটা কি দোষ করেছে??”
সাফা ঠোঁট উল্টে নাক টেনে টেনে বললো,
—” আপনি কিভাবে পারলেন আমাকে এগুলো বলতে??এ্যা এ্যা।”
—” রাস্তায় হাটার সময় চোখ কোথায় ছিলো সাফারানী??”
—” মাথায়।” রাগ দেখিয়ে বলে সাফা।
নিভ্র হাঁসে। উঠে সাফার কপালে চুমু দেয়।সাফা ওওহ বলে উঠে।নিভ্র বসে পরে সাফার হাত নিজের হাতে নেয়।তারপর করুন সুরে বলে,
—” তুমি জানো আমি কত ভয় পেয়েছিলাম??”
সাফা মুখ ঘুড়িয়ে বলে,
—” নেকা।ভয় পেলে হাসলেন কেনো??”
—” ভয় পেয়েই হেঁসেছি।তোমাকে দেখে হেসেছি।তুমি হাত পা ভাঙ্গাবে না এমন তো হতেই পারে না তাই হেঁসেছি।তা এবার তুমি খুশি!!”
সাফা বাম হাতে নিভ্রর বুকে ঘুঁষি মেরে বলে,
—” আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।তা না হলে এভাবে হাঁসতে পারতেন না!!”
—” আবার আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন??একদম আমার ভালোবাসা নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।আমি তোমাকে ভালোবাসি।এটাই সত্য।”
—” তাহলে ওই সময় বললেন না কেনো??”
—” শক্ট হয়ে গিয়েছিলাম তোমার মুখে শুনে।কিন্তু পরে যা হলো??বাদ দেও। আমার দম বন্ধ না করা পর্যন্ত তোমার শান্তি নেই।ভালোবাসায় এত পরীক্ষা হয়??এত ভয়ংকর কেনো আমার জীবন আল্লাহ ভালো জানে।এতটা ভয় আমি আগে কখনো পাইনি।আহহহ্।”
নিভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাফার চোখমুখ মুছে দিচ্ছে। আর বিড়বিড় করছে।জীবনটা ইতিহাস করে রাখা যাবে।
_____________________
রাফা মনোযোগের সাথে সাফাকে ধূসর রং এর শাড়ি পড়াচ্ছে।নিভ্র সাফার জন্য ধূসর রং এর শাড়ি চুড়ি এনেছে।আজ রাতে সমুদ্রবিলাসে যাবে সাফাকে নিয়ে।রাফা খুব সাবধানে শাড়ি পড়াচ্ছে।একটা পা একটা হাত সাফার ভাঙা।উল্টাপাল্টা হলেই বিপদ।সাফা বার বার বলছে সে যাবে না।তবুও নিভ্রর আদেশ।যেতেই হবে।হুইলচেয়ারে করে সমুদ্র ঘুড়বে ব্যাপারটা ভাবী বিরক্তির মনে হচ্ছে সাফার।সে বার বার বলছে,
—” আপু আমি এভাবে কিভাবে যাবো??আর উনার মাথা কি গেলো নাকি??”
রাফা হাঁসতে হাঁসতে শাড়ির আচঁল কাধে দিতে দিতে বললো,
—” মিষ্টির দোকান আমার তো কিছু করার নেই।ভাই বলেছে মানে যেতে হবে ব্যস।
সাফা নিরাশ হয়ে বসে থাকে।রাফা সুন্দর করে সাফার চুলগুলো ছেড়ে দেয়।
নিভ্র আর সাফা বিশাল সমুদ্রের পাড়ে রয়েছে।সাফা হুইলচেয়ারে বসে দীর্ঘ করে শ্বাস নিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে। কাল এই সমুদ্র থেকে চলে যাবে।তাই বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। নিভ্র সাফাকে কোলে তুলে নেয়।ভাঙা পা আর ভাঙা হাতে সাফাকে নিভ্রর মায়া মায়া লাগছে।মনে হচ্ছে বেচারা বাচ্চাটা একটু সমুদ্রের কাছেও যেতে পারছে না।তাই নিভ্র তাকে কোলে নিলো।সাফা অবাক হয়ে বলে,
—” ব্যান্ডেজ সহ আমি অনেক ভারী তো।নামান!!”
নিভ্র কিছু বললো না।আকাশে থালার মত বিশাল চাঁদ।চাঁদের আলোতে সাফাকে স্নিগ্ধ লাগছে।মাথার পাশে ছোট ব্যান্ডেজ।বিশাল চুল নিচে ঝুলছে।সাথে শাড়ির আচঁল। নিভ্র সাফার দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে। সাফা বাম হাতে চুল মুখ থেকে সরাচ্ছে।একের পর এক বিশাল ঢেউ আছঁড়ে পড়ছে সমুদ্রের তীরে।সামনে বিশাল আকারের মন কাড়া সমুদ্র।কালো আকাশ জুড়ে জ্যােৎস্নার মেলা বসেছে।যা আকাশ টাকে মুক্ত ধারা বানিয়ে দিয়েছে।সাফা চোখবুজে ঘ্রাণ নেয়।নিভ্র বুক ঘেঁষে মাথা রাখে।সাফার মনে হচ্ছে নিভ্রর গায়ের ঘ্রাণ আর সমুদ্রের বাতাসের ঘ্রাণ মিলে এক অদ্ভুত মতালতা সৃষ্টি করেছে।সাফা চোখ খুলে তাকায়।নিভ্র সাফাকে বালির উপড় বসিয়ে দেয়।সাফার পাশে বসে।পিছনে দু’হাত ফেলে আকাশের দিকে তাকায়।সাফা ভ্রু কুচঁকে বললো,
—” আপনি আমাকে ধূসর রং এর শাড়ি কেনো দিলেন??সাদা বা নীল দিলেই পারতেন।”
নিভ্র সাফার দিকে তাকালো।সাফার চুল ঠিক করে দিলো তারপর বললো,
—” 🍁……..
শুনেছি কবি বলেছে নীল শাড়ি আর সাদা ব্লাউজে মেয়েদের আকাশ আকাশ লাগে।তাই সবাই প্রিয়তমাকে আকাশ কিনে দেয়।কিন্তু আমি তো তা করবো না।আকাশ তো বহু দূরে।আমি বরং তোমাকে সাগর কিনে দিয়েছি।ধূসর রংয়ের শাড়ি..কেমন হয়েছে??
সাফা কিছু বলছে না হা হয়ে শুনছে।নিভ্র আবার বললো,
—” ভালোই।তুমি ধূসর রংয়ের সাগর জোড়িয়ে নিবে আর আমি সে সাগরে ভাসব…বেশ হবে।আমি তোমার সাগরে ভিজেঁই না হয় আকাশ দেখব।মনে হবে তোমার ভালোবাসা আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি। সবাই তো ভালোবাসতে পারে।কয়জনেই বা ভালোবাসা ছুঁতে পারে বলো??কিন্তু আমি পারবো।একটু আকাশ দেখব আর সাগর ছুঁয়ে দিব..সাগরের ভালোবাসায় নিজেকে ডুবাব………….
সাফা মুগ্ধ হয়ে শুনছে।নিভ্র এত সুন্দর করে কিভাবে কথা বলে??সে জানে না।কিন্তু এই সুন্দর কথা বলা লোকটা তার নিজের।এটা ভাবতেই তার মনে শীতলতা বিরাজ করে।সাফা নিভ্রর বুক জড়িয়ে বলে,
—” হুম আমি আপনার সাগর।”
নিভ্র হাঁসে আবার সামনে তাকায়।আজ কোনো কথা না সমুদ্রের সাথে তাদের নিঃশ্বাসের কথা হবে।
.
.
#চলবে________________

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *