আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 23

ফলমূলসহ শুকনো কিছু খাবার নিয়ে হাসপাতালে ফিরতে ফিরতে রাত নয়টার মতো বেজে গেল মুবিনের। ঘামে কর্দমাক্ত শরীর নিয়ে ফ্যানের নিচে বসে ঘনঘন কিছু নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। আঁড়চোখে দু-একবার চৈতালিকে পর্যবেক্ষণ করে চোখজোড়া বুজে ফেললো। মেয়েটি আর আগের মতো নেই। বয়স বেড়েছে, শরীরে এসেছে এক অস্বাভাবিক ভারত্ব। মুখে পড়েছে বয়সের ছাপ। পাঁচ বছর আগের এবং বর্তমান সময়ের চৈতালির পার্থক্য করলেই স্পষ্ট তার চেহারায় ফুটে ওঠে অযত্নের ছাপ।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো মুবিন। চোখজোড়া মেলে চমকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ঘুমিয়েছে কখন?”
“একটু আগেই.. তুমি আর রাত করো না। বাড়ি ফিরে যাও।”
“যাবো.. তবে তোমার কোনো ভয় নেই। শফিক ভাইকে তোমাদের কথা বলা আছে। কিছু দরকার হলে যেকোনো নার্সকে ডেকে শফিক ভাইয়ের নাম বললেই উনারা সব ম্যানেজ করে দেবে।”
ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললো চৈতালি।
“আমি ভয় পাচ্ছি না.. তবে বাড়ির কথা ভেবে চিন্তা হচ্ছে। এতক্ষণে হয়তো পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গেছে আমি অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছি।”
“ভাবুক না! তাদের ভাবনাতে তোমার কী!”
মেঝের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মুবিনের দিকে দিল চৈতালি। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“এসবের মাঝে তোমাকে জড়ালে?”
“জড়াক.. আমার কিছু যায় আসে না তাতে। তুমি খেয়ে নিয়েছো?”
মুবিনের প্রসঙ্গ বদলানোর তাড়াহুড়ো দেখে বুকের ভেতরটায় হালকা কম্পন অনুভব করলো চৈতালি। বুকচিরে বেরিয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো,
“না..”
“খেয়ে নাও তাহলে.. আমি বরং এখন উঠি। সকালে আবারও আসবো।”
মুবিন উঠে দরজার দিকে এগুতেই তাকে থামিয়ে দিল চৈতালি।
“একটা মিনিট দাঁড়াবে?”
পিছন ফিরে চৈতালির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক সুরে মুবিন বললো,
“কিছু লাগবে?”
“তোমার কেন মনে হয় আমার কিছু লাগবে বলেই স্বার্থপরের মতো তোমার কাছে ফিরে এসেছি?”
“আমি সেভাবে কিছু বলিনি..”
কাঁপা স্বরে মুবিন বলে উঠতেই উঠে দাঁড়ালো চৈতালি৷ কয়েক কদম এগিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,
“তুমি যদি সেদিন আমাকে বিশ্বাস করতে তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না.. আজ আমার সামনে তোমায় এভাবে জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না।”
ঘাড় উঁচিয়ে দুজনের মাঝের দূরত্ব বাড়াতে এক পা পিছিয়ে গেল মুবিন।
চৈতালি বললো,
“আমি কিন্তু আমার পেছনে ফেরার সকল রাস্তা বন্ধ করে তোমার কথায় এখানে এসেছি মুবিন।”
“আমি জানি.. তোমাকে এনিয়ে ভাবতে হবে না।”
“তাহলে তুমি কেনো স্বাভাবিক হতে পারছো না আমার সাথে?”
“সময় লাগবে আমার। এটুকু সময় আমাকে অন্তত দাও।”
বুকে চেপে রাখা লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে চৈতালি ছেলের কাছে ফিরে যেতেই দরজা খুলে কেবিন থেকে বেড়িয়ে করিডোর ধরে সামনে এগুলো মুবিন। বুকের ভেতরটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে তার। নিঃশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে…
একটি সিএনজি ডেকে তাতে নির্বিকারচিত্তে উঠে বসলো মুবিন। পকেটে থাকা সিগারেটের প্যাকেট বের করে তা ধরিয়ে সিএনজি চালকের উদ্দেশ্যে বললো,
“আর কোনো যাত্রী উঠাবেন না। আমি সিএনজিটা রিজার্ভ করে নিয়ে যাব।”
সিএনজি চালক ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হেসে সামনের দিকে তাকাতেই সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে সিগারেটে টান দিল মুবিন। ফোন বের করে পুষ্পর নাম্বারে কল করে অপেক্ষা করতে লাগলো তার একটি সাঁড়ার। পুষ্পকে আজ সবটা বলে দেবে সে। এভাবে পুষ্পর কাছ থেকে সবটা লুকিয়ে চৈতালিকে ঠকাবে না সে। কখনোই ঠকাবে না..
“বলুন.. বাসায় ফিরেছেন?”
ফোন ধরেই পুষ্পর গলার স্বর শুনে অস্থিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠা বুকের ভেতরটা শান্তিতে ভরে উঠলো মুবিনের। চোখজোড়া বুজে সে মুগ্ধ গলায় বললো,
“ফিরছি.. কী করছিলে? রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছো?”
“উহু.. খাবো একটুপর। আপনি জানেন বাবা আজ কী বলেছে?”
“কী?”
“বলেছে জামাইকে ডেইলি ডেইলি রান্না করে খাবার না দিতে যেয়ে এখানে এসে রাতের খাবারটা খেয়ে যেতে বললেই তো পারো। তাহলে আমাদেরও ডেইলি ডেইলি ভালো খাবার খাওয়ার ভাগ্য হয়।”
চোখমুখে হাসির রেখায় চিকচিক করে উঠতেই চোখজোড়া মেললো মুবিন। সোজা হয়ে বসে হাতের সিগারেট গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বললো,
“তারপর?”
“তারপর আর কী? আমি বললাম তোমার খেতে ইচ্ছে হলে আমায় বলো। আমার বরকে নিয়ে তবুও হিংসা করো না! ঠিক বলেছি না বলুন?”
বর শব্দটি কানে আসতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুবিন। পুষ্পদের বাড়িতে সবকিছু যেহেতু ঠিকঠাক ভাবে চলছে সেহেতু মেজভাই কিচ্ছুটি জানায়নি তাদের। আর না সে নিজেও পুষ্পর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারছে কিছু। তবে এভাবে আর কতদিন? আর কতদিন সে এভাবে হাবুডুবু খেয়ে বেড়াবে অথৈ সমুদ্রের মাঝে?
“আপনার বন্ধুর ছেলের এখন কী অবস্থা?”
ফোনের ওপাশ থেকে পুষ্প প্রশ্নটি করতেই মৃদু স্বরে মুবিন বললো,
“ভালো..”
“যাক! দ্রুত সুস্থ হোক এই কামনাই করি। ওহহো! মেজভাইয়ের এখন কী অবস্থা তা জানতেই তো ভুলেই গেছি!”
ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেললো মুবিন।
“কেনো? মেজভাইয়ের কী হয়েছে?”
“বাবা সন্ধ্যায় বললো মেজভাই নাকি অসুস্থ। সকালে হসপিটালে এলেও শরীর খারাপ ছিল প্রচুর। আপনি জানেন না বিষয়টি?”
বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো মুবিনের। তবে কি গতকালের তার কথার জের ধরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেজভাই? দ্রুত পুষ্পকে ফোনে বিদায় দিয়ে ভাইয়ের নাম্বারে ডায়েল করলো মুবিন। অধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতেই মেসবাহ কল ধরে অপরপ্রান্ত থেকে গম্ভীর স্বরে বললো,
“তুই যা চাইছিস তা আমি করতে পারবো না।”
“পারতে হবেনা। তুমি কোথায় এখন? কেমন আছো? শরীর ঠিক আছে?”
“হসপিটালে.. আর শরীরও ঠিক আছে। তবে এত ঘটা করে কল করে এসব জিজ্ঞেস করার কোনো কারণ?”
“তুমি আমার ভাই.. এটাই কি যথেষ্ট কারণ নয় কল করে তোমার খোঁজ খবর নেয়ার?”
“এতদিন থাকলেও গতকাল থেকে তা যথেষ্ট নয়।”
একমুহূর্ত থেমে মুবিন বললো,
“তুমি কী চাইছো ভাইয়া? আমি চৈতালির দুঃসময়ে ওর পাশে না থাকি?”
“দুঃসময়ে পাশে থাকা মানে এই নয় মেয়েটিকে নিজের জীবনের সাথে বেঁধে ফেলা। হেল্প মানুষকে নানানভাবে করা যায়।”
“আর মেয়েটিই যদি তার সবটা ছেড়েছুড়ে আমার কাছে চলে আসতে চায়? তবে?”
কন্ঠে উদ্বেগ ফুটিয়ে মেসবাহ বললো,
“তবে তাকে বোঝানো। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। না সেদিন তুমি থেমে ছিলে আর না আমি আজ থেমে আছি।”
উত্তরে ফোনের ওপাশ থেকে মুবিনের কিছু দীর্ঘশ্বাস কানে আসায় একদন্ড থামলো মেসবাহ। ভাইকে স্বাভাবিক হবার খানিকটা সময় দিয়ে বললো,
“তোকে চৈতালির বিষয়টি কে জানিয়েছিল? উল্লাসী?”
“না..”
“তাহলে কে? বড় ভাবি?”
“না.. আনিস।”
“সিউর? তুই কোনোভাবে উল্লাসীর নামটা ঢাকতে চাইছিস না তো?”
“না.. আমি রাখছি।”
ফোন কেটে আবারও সিটে শরীর এলিয়ে দিল মুবিন। মনের ভেতরের অশান্তি আবারও নতুন করে শুরু হয়েছে তার। সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটিয়ে যেতে পারছে না কোনো এক তীরে।
বাসায় ফিরে খানিকক্ষণ নীরবে অন্ধকারে কাটানোর পর ঘরের আলো জ্বেলে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিল উল্লাসী। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে। চারিদিকের লোকজনের কোলাহল কমে আসছে ধীরেধীরে। মেসবাহও হয়তো বাড়ি ফিরবে কিছুক্ষণের মাঝেই। তবে তার আগে তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। এভাবে বিপর্যস্ত চেহারা নিয়ে তার সামনে গেলে একমুহূর্তে সে ধরে ফেলবে জাভেদের বিষয়টি। ভেবে ওয়াশরুমে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই তার নজরে এল জাভেদের দেয়া চুড়ি। সাথেসাথেই সে এগুলো ড্রেসিংটেবিলের দিকে। চুড়িগুলো নিয়ে তা ময়লায় ঝুড়িতে ফেলে টিপের পাতায় জ্বালিয়ে দিল আগুন।
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো উল্লাসী। ভাতের চাল ধুয়ে রাইস কুকারে তুলে দিয়ে ফিরে এল ঘরে। সন্ধ্যায় ইভানা তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। তার মুখ থেকে জাভেদের কাহিনী শুনে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। বলেছে কঠিন কিছু কথাও। কথাগুলো স্মরণ করার চেষ্টায় চোখজোড়া বুজে ফেললো উল্লাসী। ভেজা চুলগুলো বিছানার মাঝবরাবর ছড়িয়ে দিয়ে শরীর এলিয়ে দিল খুব ধীরে।
“তুমি বড্ড বোকা উল্লাসী। খুব দূরে নয়.. তোমার ননদ অনার কথাটাই একবার ভাবো। কী মনে হয় তোমার? জাভেদ নামের লোকটা তোমার সাথে ওমন করতে পারতো না? পারতো.. এই জগতে কেউ কারো আপন নয়। এই জগতের মানুষকে বিশ্বাস করতে প্রয়োজন বিশাল এক পাঁজর। তাছাড়া মেসবাহ তোমার স্বামী.. তুমি বিগত পাঁচটি বছর হলো দেখে আসছো ওকে। তোমার কি এই কয়েক বছরে মনে হয়েছে মেসবাহর ভেতর সন্দেহজনক কিছু রয়েছে যাতে ওকে বিশ্বাস করা যাবে না?”
জবাবে উল্লাসী মাথা নাড়তেই ইভানা পূর্ব সুরেই বললো,
“তাহলে কেনো তুমি বাইরের এক লোককে বিশ্বাস করে মনের কথা শেয়ার করতে গেলে? তাকে কেনো তোমার বিশ্বস্ত মনে হলো? একজন মেয়ে কখন এই কাজ করে জানো? যখন আপনজনের প্রতি বিশ্বাস সে হারিয়ে ফেলে। তুমিও কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলে?”
থেমে গেল ইভানা। খানিকটা সময় নিয়ে কথার সুর পরিবর্তন করে আবারও বললো,
“আমি তোমার বড় বোনের মতো। কখনো যদি তোমাকে বকি তবে সেই অধিকারেই বকি। কখনো যদি তোমার উপদেশ দেই সেই অধিকারেই দেই। তবে তাতে যদি তুমি কষ্ট পাও বা মনে হয় আমি তোমার উপর বা তোমার সংসারে কর্তৃত্ব ফলাতে চাইছি তবে নিঃসংকোচে আমায় বলতে পারো। তবে কখনোই এমন কোনো কাজ করবে না যাতে অন্যের সম্মানহানি ঘটে বা মনে কষ্ট পায়।”
ইভানার কথার গভীরতা বুঝে ফুঁপিয়ে উঠলো উল্লাসী। অস্পষ্ট সুরে কোনোমতে বললো,
“স্যরি..”
“কোনো ব্যাপার না.. আমি আপসেট হয়ে পড়েছিলাম। তবে সময়ের সাথেসাথে তা কেটে গেছে। তবে আমি কখনোই তোমাদের মাঝের থার্ড পার্সন নই। তোমার বড় বোন থাকলে অবশ্যই তোমার সংসারে ঝামেলা বাঁধলে তা মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো। যা ভেবেই আমি তোমায় ম্যাসেজ করতাম। আমি তোমার সাথে কমিউনিকেশনে থাকার চেষ্টা করতাম। আর মেসবাহকে যেভাবে সাপোর্ট দিতাম তা শুধুই একজন ভালো বন্ধু হিসেবে। থাকেনা কিছু সম্পর্ক? যা রক্তের না হলেও আত্মার হয়?”
“স্যরি..”
“ইটস ওকে বাবা! তবে আরেকটি কথা.. হ্যাঁ, আমি কোনো সাফাই গাইবো না। আমি যেহেতু হিউম্যান বিং সেহেতু ভুলত্রুটি আমার দ্বারা হতেই পারে। তবে তোমার চিন্তাধারায় প্রগ্রেস আনা উচিৎ। আসলে দোষটি তোমারও না.. আমাদের সোসাইটির। আমাদের সোসাইটিতে সকলে ‘ইন্সিকিউরিটি ফ্রম পার্টনার্স ফ্রেন্ডশিপ উইথ অপোসিট জেন্ডার’ পন্থায় বিশ্বাসী। একজন ছেলের বিয়ের পর বা রিলেশনের আগে কোন মেয়ে বেস্টফ্রেন্ড থাকলে তার ওয়াইফ বা প্রেমিকা বিষয়টি মেনে নিতে পারেনা। তার কেনো যেন প্রথম থেকেই একটি উদ্দেশ্য থাকে.. আর সেটি হলো তাদের ফ্রেন্ডশিপটি ব্রেক করা। অথবা জেলাস ফিল করা। আমাদের সমাজও কিন্তু তার এই উদ্দেশ্যে মেয়েটিকে সাপোর্ট করে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয়তো এক সময় জেলাসির পরিমাণ বেশি হওয়ায় মেয়েটা শর্ত জুড়ে দিয়ে বসে হয় আমি না হয় তোমার বান্ধবী! বেছে নাও তুমি। ব্যস! সেখান থেকেই সূচনা হয় সম্পর্কে ফাটলের। অথচ তাদের সেই ফ্রেন্ডশিপকে যদি রেস্পেক্ট করা হয়, তাদের ফ্রেন্ডশিপে বন্ধুস্ত্রী হিসেবে জয়েন করা হয়, সকলের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে মিশে যাওয়া হয় তাহলে কিন্তু বিষয়টি একদম অন্যরকম হত। তবে আমাদের সমাজ তা কখনোই হতে দেয়না। স্বামীর বন্ধু, স্বামীর বান্ধবী মানে সময়ের অপচয়, অযথা আড্ডা না হয়ে যদি বিষয়টি এমন হতো বাইরে আড্ডা কেনো দিচ্ছো? সবাই চলে এসো বাসায়। আমি চা করি। বাসায় বসে আড্ডা দাও। তবে ব্যাপারটি সুন্দর হতো না?”
“আমি সবার সাথে মিশতে পারিনা..”
“মিশতে আমিও পারতাম না। তবে এখন পারছিনা? সময়ের সাথেসাথে সবকিছু শিখে নিতে হয়। এই যেমন তুমি এখন মেডিকেল কোচিং করছো। কয়েকবছর পর হয়তো ডাক্তারের খাতাতেও নাম উঠাবে। তখন কি মনে হয় তুমি আজকের এই উল্লাসীই থাকবে? তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব বা কলিগ হবে না? তাই বলে কি সেসব বিষয়ে মেসবাহ সন্দেহ করবে তোমায়? কখনোই না.. করলে অবশ্যই জাভেদের বিষয়টি এত দূর আগাতে পারতো না।”
ইভানার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে চাইলো উল্লাসী।
ইভানা স্বাভাবিক সুরে বললো,
“তোমাদের মাঝে যা হচ্ছে পুরাটাই এইজ গ্যাপের জন্য হচ্ছে। তুমি ভাবছো একরকম করে আর মেসবাহ আরেক। তোমার দুজনের একপাক্ষিক চিন্তাভাবনা করে পুরো বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলছে। মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভাব তো আছেই.. তবে সবকিছুর মাঝে স্বস্তির জায়গাড়া কোথায় জানো? তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। একে অপরকে গভীরভাবে চাও। আর একারণেই তোমাদের সম্পর্কের শিকলটি বেশ মজবুত। এইজ গ্যাপ, মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ম্যাচুরিটি, রিকোয়েরমেন্ট নামক বড়বড় শব্দগুলোও তোমাদের এই শিকলের কাছে বেশ তুচ্ছ।”
দরজায় বেজে উঠা কলিংবেলের শব্দে স্মৃতিচারণ ছেড়ে ফিরে এল উল্লাসী। লম্বা কিছু নিঃশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে একটি চিরকুট লিখে তা ড্রেসিংটেবিলে রেখে এগুলো সদর দরজার দিকে।
দরজা খুলে মাথা নীচু করে উল্লাসীকে একপাশ হয়ে দাঁড়াতে দেখে মেসবাহ ঢুকে গেল ভেতরে। শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই তার নজরে এল সাদা কাগজের একটি টুকরো। কপাল কোঁচকালো সে। আশপাশে দৃষ্টিপাত করে তা উঠাতেই গোটাগোটা অক্ষরে দেখতে পেল উল্লাসীর হাতের লেখা।
‘প্রতিবার ভুল করি.. প্রতিবার মাফ চাই। আর আপনিও খুব সহজে মাফ করে দেন। তবে এবার দেবেন না। এভার আমাকে কঠিন কোনো শাস্তি দিন। কারণ, কঠিন কোনো শাস্তি না দিলে এই উল্লাসী মানুষ হবে না।’
ঠোঁটে হাসি ফুটলো মেসবাহর। চিরকুট হাতে নিয়ে সে উল্লাসীর খোঁজে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। নীরবে দাঁড়িয়ে তাকে তরকারি গরম করতে দেখে বেশ উচ্ছাসিত গলায় বললো,
“মেয়েটির মন খারাপ?”
মেসবাহর হাসি অশান্ত মনে স্বস্তি ফেরালো উল্লাসীর। চুলোর আঁচ কমিয়ে দিয়ে সে মেসবাহর দিকে এগিয়ে এসে ডান গাল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“ওই গালেই মেরেছিলেন না? এখন নিন এই গালে আরেকটা মারুন।”
“কেনো? একগালে মেরেছি জন্য বিয়ে হবেনা বলে?”
হাসির ঝলক ফুটলো উল্লাসীর মুখেও। মেসবাহর টিশার্টে আঙ্গুলে প্যাচাতে প্যাচাতে সে বললো,
“মজা করবেন না! এমনিতেই গালটা জ্বলেপুড়ে আমার ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এখন এই জখমে মলমটাও আপনিই লাগিয়ে দিন.. যদিও দুইদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। তবে আপনি চাইলে এখনো মলম লাগিয়ে দিতে পারেন। আমি কিছুই মনে করবো না।”
“খুব জোরে লেগেছে?”
মেসবাহ ব্যথিত মুখে কপাল কোঁচকাতেই পা উঁচিয়ে মেসবাহর কলার চেপে ধরলো উল্লাসী। ঠোঁটে দুষ্ট হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“আগেই মলম আনার জন্য দৌড়াবেন না! জানতাম আপনি বুঝবেন না! তবে আমি বুঝিয়ে দেবো। এখানে, মলম ইজ একুয়ালটু চুমু.. এবার প্রমাণ করুন চুমুই ব্যথা নিবারনের একমাত্র মহা ঔষধ।”
(চলবে)