আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 12

“এই নিন আমার ফোন।”
রেস্টুরেন্টে ঢুকতে না ঢুকতেই পুষ্পর এমন কথা শুনে অবাক হলো মুবিন। মেন্যু কার্ড থেকে চোখ সরিয়ে সে কপাল কোঁচকাতেই ওপাশ থেকে পুষ্প আবারও বললো,
“কাল যে বললেন আমার ফোনটা আপনার খুব প্রয়োজন!”
ততক্ষণে পুরো ব্যপার বোধগম্য হতেই খানিকটা হতাশ হলো মুবিন। গতকালের বিষয়টি সে আজই ভুলে গেলো! এতটা উদাসীন তো সে ছিল না। সকলের কাছেই সে যেখানে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সেখানে এই উদাসীন শব্দটি তার সাথে মোটেও যায় না! ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসলো মুবিন। পুষ্পর হাত থেকে ফোন নিয়ে তার দেয়া নাম রিমুভ করে সেইভ করে দিল মুবিন নামে।
“খাবারের অর্ডার তাহলে এবার দিয়ে দেই?”
“দিন.. তবে কাল থেকে আমার মনে একটা কথা ঘুরছিলো। বলি?”
“নিশ্চয়..”
কপালের চুলগুলো সড়িয়ে নিল পুষ্প।
“আপনি আপনি করে ডাকাটা আমার আজকাল বেশ অদ্ভুত লাগছে! আমরা কি আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসতে পারি?”
পুষ্পর করা প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে ওয়েটার বয়কে ডেকে খাবার অর্ডার দিল মুবিন। তারপর আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক সুরে বললো,
“তোমার কাছে আমি কিছু কনফেস করতে চাই।”
মৃদু হেসে পুষ্প বললো,
“আমিও চাই.. কে আগে কনফেস করবো?”
“লেডিস ফার্স্ট।”
সময় নিল পুষ্প। বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে উদাস গলায় বললো,
“আমার মা যখন মারা যান তখন আমি ক্লাস এইটে ছিলাম। আপু এইচএসসি দিচ্ছিলো আর ভাইয়া তখন মাস্টার্সে। তবে মার মৃত্যুর পর কেমনই যেনো সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো করলেও গোছানো ছিল না কিছু। বাবা সারাদিন নীরবে বসে কী যেন ভাবতো। আপু বই নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। আর সকাল হলেই পরীক্ষার জন্য ছুটতো। আর ভাইয়া.. রাতে বাড়ি ফিরতো কী ফিরতো না তা দেখারও কেউ ছিল না। ঘটনার সুত্রপাত কিছুটা আপুর শেষ পরীক্ষার আগের রাত থেকেই। আপু বইখাতা নিয়ে বসেছিলো সন্ধ্যার পর। বাবা এসে আপুকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এখন বিয়ে করতে চাও? আপু প্রশ্নটি শুনে বেশ অবাক হলেও বাবাকে বললো, তুমি চাইলে আমিও চাইবো। ব্যস! আপুর তার সাতদিন পরেই বিয়ে হয়ে গেল বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে। বোর হচ্ছেন?”
“উহু..”
“সেসময় আমি বাসায় একা থাকতাম। ভাইয়া সারাদিন ভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আর বাবা তার ব্যবসা নিয়ে। বাড়ি দেখাশোনার জন্য জলিল নামের বৃদ্ধ এক লোক ছিল আর তার স্ত্রী আমাদের গৃহ পরিচালিকার কাজ করতো। আমি রোজ স্কুল থেকে ফিরে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে ঘন্টাদুই ঘুমিয়ে নিতাম। সেদিনও ঘুমোচ্ছিলাম। তবে হঠাৎ উরুতে হালকা সুড়সুড় করে উঠতেই তন্দ্রাভাবটা কেটে গেল আমার। সেখানটায় চুলকে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে পাশ ফিরতেই আমার দম বন্ধ হয়ে এল। বুঝলাম কেউ একজন আমার মুখে বালিশ চাপা দিয়েছে। অসহনীয় এক যন্ত্রণায় আমার চোখে অন্ধকার নেমে আসছে।”
কাঁপা স্বরে এটুকু বলেই থেমে গেল পুষ্প। মুবিন পুরো ঘটনা খানিকটা আন্দাজ করতে পারায় তাকে আস্বস্ত করতে চেপে ধরলো তার হাত।
“আমি যখন বুঝলাম আমার পাইজামা নিচে টেনে নামাচ্ছে লোকটি তখন আর চুপচাপ থাকলাম না। নিজের সবটা দিয়ে প্রচুর ধস্তাধস্তির পর ধীর স্বরে আর্তনাদ করে উঠতেই মোমেনার মায়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম। সে চিৎকার করে গালিগালাজ করে যাচ্ছিলো তার স্বামীকে।”
বুক থেকে যেনো পাথর সমান বোঝা নেমে গেলো পুষ্পর। বাতাসে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বললো,
“জানেন? আমাদের চার বছরের সম্পর্কের পর যখন আমাদের বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিলো তখন এভাবেই এক রেস্টুরেন্টে বসে ওকে পুরোটা জানিয়েছিলাম আমি। তবে ও আমাকে বুঝে, বা আমাকে ভরসা করে এভাবে আমার হাত আঁকড়ে ধরেনি। এক নিমেষে সবটা ভুলে গিয়েছিল। চোখভর্তি ক্রোধ নিয়ে বলেছিল, আগে কেনো জানাওনি এসব কথা? মোমেনার মা যে সঠিক সময়ে এসেছিল তার প্রমাণ কী? তুমি যে ওই রাসকেলটার দ্বারা রেপ হওনি তার প্রমাণ কী? তবে আমি ওর কোনো প্রশ্নর জবাব দিতে পারিনি। বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো আমার। স্তব্ধতা কাটিয়ে যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম তখন ও আমায় একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল…”
“আমি যাচ্ছি না.. দেখলে না নাম চেইঞ্জ করে দিলাম?”
মুবিনের কথায় হেসে উঠলো পুষ্প। জলভরা চোখে ঠোঁটের কোণায় তার পরিতৃপ্ততার এক হাসির ঢেউ। এ হাসি একটি বন্ধনের, একবুক বিশ্বাস এবং ভরসার। বুকটা তৃপ্ততায় ভরে উঠলো মুবিনেরও। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে পুষ্পর দিকে চাইতেই পুষ্প বললো,
“এবার আপনারটা বলুন।”
“জানো? তুমি বেশ সুন্দর করে হাসো?”
“এটাই কনফেস করার ছিল আপনার?”
“হ্যাঁ..”
মনকে শক্ত করে মৃদু হাসলো মুবিন। মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ে আবারও মন খারাপ করে দেবেনা সে। তবে বিশ্বাস শব্দটির উপরও আঘাত হানবে না। শুধু অপেক্ষা একটি উপযুক্ত সময়ের।
মনটা আজ ভিষণ রকমের ভালো পিংকি রহমানের৷ গতকাল রাতে মুন্নি সরকারের সাথে কথা হবার পর থেকেই আনন্দে তার মনের ভেতরটা লাফাচ্ছে। রাতে ঠিকঠাক ভাবে ঘুমটাও হয়নি। বারেবারে তার অস্থির মন ভাবিয়েছে আজকের দিনকে ঘিরে। ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে পাশের সিটে বসা পাপিয়ার দিকে তাকালেন তিনি। কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। বয়সের আভাসও একবিন্দু ফুটে উঠছে না। যে কেউ একনজরে দেখেই নিজের বউ করে নিতে বাধ্য! সেখানে মুন্নি সরকারের ভাই কে? বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বামী মুত্তালিব রহমানের দিকে তাকালেন পিংকি রহমান। লোকটিকে বারবার বলেছিলো পাঞ্জাবী পরতে। অথচ সে পরেছে একটি গেঞ্জি আর প্যান্ট। যাতে তাকে দেখতে নিতান্তই এক আবুল লাগছে। লোকটি কি কোনোদিনই তার কথা শুনবে না? মনে চলা প্রশ্নটির জবাব না মিললেও মিলে গেলো মুন্নি সরকারদের বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে তারা বিল্ডিংয়ের দিকে এগুতেই পাশ থেকে রুমা বললো,
“ভাবি, ওইযে! একটা পিচ্চি বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে না? ওটাই ভাইয়া।”
মনের ভেতরটা খুশিতে ভরে উঠলো পিংকি রহমানের। ছেলেটি আসলেই বেশ সুদর্শন।
“দেখতে তো মাশাল্লাহ। সাথের ওই পিচ্চি মেয়েটা কেরে?”
“জানি না ঠিক। উনার বোনের মেয়ে হতে পারে..”
ওপাশ থেকে হাসান সরকার এবং মেসবাহ তাদের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতেই হ্যান্ডশেকের জন্য হাত এগিয়ে দিলেন মুত্তালিব রহমান। সময় নিয়ে হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করে তারা এগুলো বিল্ডিংয়ের ভিতরের দিকে।
kothay tumi? Amra to ese porechi.
-Ruma
উল্লাসীর নাম্বারে ম্যাসেজখানা করেই সোফায় বসলো রুমা। বাড়ির ভেতরটা দেখতে চারপাশে নজর বোলাতেই তার নজরে এল বেশ মোটাতাজা গড়নের এক মহিলা। যিনি হাসি মুখে এগিয়ে আসছে তাদের দিকেই।
“আরে এসে পড়েছেন যে! আমি মুন্নি সরকার। আপনি পিংকি ভাবি তো?”
“হ্যাঁ.. ভালো আছেন? কালকে রাতে কথা হবার পর থেকেই আপনাকে দেখার বেশ ইচ্ছে ছিল। যাক! সে শখ তাহলে পূরণ হলো। আপনার গলাটা কিন্তু বেশ মিষ্টি।”
বললেন পিংকি রহমান।
জবাবে হেসে উঠে মুন্নি সরকার তাকালেন পাপিয়ার দিকে। মেয়েটি ছবির মতো দেখতে না হলেও অসুন্দর নয়। বয়স্কও লাগলেও তার ভাইয়ের সাথে মানিয়ে যাবে বেশ। ভেবে নিজের মনকে সান্তনা দিয়ে মুন্নি সরকার বললেন,
“তাহলে আসুন খেতে বসে যান। নাকি খানিকটা জিড়িয়ে নেবেন?”
“আরে আগে তো বসি। নিজেদের মাঝে খানিকক্ষণ আলাপ হোক। খাওয়াটাই কি আসল নাকি!”
“তা নয়.. তবে আমাদের দিক থেকে সব রেডি আছে।”
হাসলেন পিংকি রহমান। বোনের দিকে ইশারা করে বললেন,
“ও দারুণ রাঁধতে পারে বুঝেছেন? দেশের বাইরে ছিল না? ওখানে কি আর দেশি খাবার পাওয়া যায়? তাই যখন দেশি খাবার খেতে ইচ্ছে হতো তখন নিজেই রাঁধতো। এই তুই কী কী যেনো রাধতে পারিস?”
কথোপকথন খানিকটা এগিয়ে যেতেই মেসবাহর দিকে তাকালেন পিংকি রহমান। ছেলেটির কোলেই পিচ্চি মেয়েটার বসতে হবে? তাছাড়া ছেলেই বা কেনো এতটা দূরত্ব রেখে বসবে? কপাল কুঁচকে গেলো তার। তবে দ্রুতই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মুন্নি সরকারের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“ছেলে আর মেয়েকে তাহলে একসাথে বসান। আমরাও তাদের একসাথে দেখে চোখ জুড়াই।”
পাশ থেকে মুত্তালিব রহমান স্ত্রীর কাজকর্মে ভ্রু কুঁচকে ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“আরে এখনই কেনো! মাত্র তো আসলে।”
“তুমি চুপ করো তো।”
“তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কথাবার্তা না এগিয়েই..”
“চুপ..”
স্বামীকে ঝাড়ি মেরে পিংকি রহমান থামিয়ে দিতেই মুন্নি সরকার বললেন,
“হ্যাঁ.. হ্যাঁ। ভাইয়া আসুক। এই ভাইয়া?”
বড় ভাইকে ডেকে আনছে অথচ বাবা-মার কোনো খোঁজ নেই? তবে কি তাদের মন মেজাজ খারাপ? নাকি হাওয়া খেতে বেরিয়েছে? মনে চলার প্রশ্নে নিয়ে খানিকটা অসন্তোষ হলেন পিংকি রহমান। ছেলের বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে অথচ আর বাবা-মা হাওয়া খেতে কেন বের হবে? নড়েচড়ে বসলেন তিনি। মৃদুস্বরে বললেন,
“ছেলে ডাক্তার শুনে প্রথমে আমার একটু দ্বিমত ছিল বুঝেছেন? শুনেছি ডাক্তারদের নাকি কোনো আরাম আয়েশ নেই। ছুটিছাটাও খুব কম। ইমারজেন্সি কেইস আসলেই নাকি ছুটতে হয়! বউ বাচ্চার কথা নাকি তখন স্মরণ থাকে না।”
অবাক বনে গেল উপস্থিত সকলে। মুন্নি সরকার ঘাবড়ে গিয়ে তাকালেন হাসান সরকারের দিকে। উল্লাসী কি তবে মিথ্যা বলেছে শীতলের নামে? নয়তো বেকার এক ছেলের সাথে বিয়ে দেবার জন্য কেনো এতো হুড়োহুড়ি? ঢোক গিললো মুন্নি সরকার। মুখ ঘুরিয়ে পিংকি রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ.. সেটাই। আরাম নেই একদম!”
হাসান সরকার ডাক্তারের কেইস নিয়ে বেশ একটা ঘাটাঘাটি না করে মুন্নি সরকারকে খানিকটা ফাঁকে এনে ধীর জিজ্ঞেস করলেন,
“কে ডাক্তার? আমাদের শীতল?”
“তুমি চুপ করো।”
“কী আশ্চর্য! তুমি কি পাগল হলে?”
“পাগল কেনো হবো? ভাইয়া এখন ডাক্তার না। তবে ভবিষ্যতে হবে।”
“ডাক্তার হওয়া কি মুখের কথা? তোমার কাছে কি সেসব ডালভাত মনে হয়?”
“ডালভাত কেন মনে হবে? শীতল ভাই দরকার হলে হাতুড়ে ডাক্তার হবে। নয়তো হোমিওপ্যাথি।”
হাসান সরকার নিজের মাথা চাপড়ে বিরক্ত হয়ে বললেন,
“তোমার মাথা কি এইবার একেবারে গেল?”
“তুমি কথা বলবে না কোনো। চুপ করে থাকো। আমার ভাইয়ের ভালো একদম সহ্য করতে পারো না তুমি।”
গজগজ করতে করতে মুন্নি সরকার ঢুকলেন শীতলের ঘরে। ডাক্তার হওয়া খুব কঠিন নাকি? বড় কোনো ঔষধের দোকানে দুই দিন কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করে তৃতীয় দিনেই নিজেকে ডাক্তার ভাবা একদম অযৌক্তিক নয়।
“এটা কেরে? ছেলের বড় ভাই?”
“কীযে!”
“তো বড় ভাইকে মেয়ের কাছে বসালো কেনো? মহিলার বুদ্ধিশুদ্ধি কি গাছে উঠেছে?”
“আমি কী জানি!”
রুমার উত্তরে বেশ বিরক্ত হলো পিংকি রহমান। মেসবাহর দিকে তাকিয়ে তিনি বললো,
“আপনি বরং এখানটায় বসুন। আর ভাইয়া আপনি উনার জায়গায় বসুন।”
সামনে থেকে কপাল কুঁচকে ফেললেন মুন্নি সরকার।
“কেনো? ভাইয়া কেনো ওখানে বসবে?”
“আপনি ভুল জায়গায় ভুল মানুষ বসালে ঠিক করে দিব না?”
“ভুল মানুষ মানে? আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?”
“যার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে তার সঙ্গে না বসিয়ে আপনি তার বড় ভাইয়ের সাথে বসাচ্ছেন.. অথচ আপনি বলছেন আমি ঠিক কী বলতে চাইছি! আর উল্লাসী কই? উল্লাসীর খালা খালু? উনারা কোথায়?”
পিংকি রহমানের কথায় বাজ পড়লো পুরো ঘরজুড়ে। সকলের স্তব্ধতা না কাটতেই মাঝ থেকে মৈত্রী বলে উঠলো,
“মা তো কোচিংয়ে।”
পুরো ব্যাপারে কোথাও ঘাপলা আছে বুঝে উঠতে পারায় ঘেমে মেসবাহর পুরো পাঞ্জাবি ভিজে উঠলেও চুপচাপ বসে থাকাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছিলো তার। তবে হঠাৎ মৈত্রীর কন্ঠ কানে আসতেই মেয়েকে চুপ করতে বললো সে।
“মৈত্রী চুপ। বড়দের মাঝে কথা বলতে হয়না।”
“তো মায়ের কথা জানতে চাইলে তা কেনো বলবোনা বাবা?”
এবারে বিশাল আকারের একটি বাঁশ যেনো ভেঙে পড়লো পিংকি রহমানের মাথায়। চোখমুখ কুঁচকে তিনি মেসবাহকে উদ্দেশ্য করে অস্থিরতা নিয়ে বললেন,
“এই পিচ্চি কে? আপনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ..”
“আপনি বিবাহিত?”
“হ্যাঁ..”
ঢোক চেপে বললো মেসবাহ।
পিংকি রহমান একবার রুমার পরমুহূর্তেই আবার মেসবাহর দিকে চেয়ে বললেন,
“তাহলে যে উল্লাসী বললো আপনার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে!”
“পাগল হয়েছেন? উল্লাসী নিজের স্বামীর জন্য পাত্রী কেন খুঁজবে? ও হয়তো শীতলের কথা বলেছে!”
হাসান সরকার মাঝ থেকে বলে উঠতেই যেনো হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গেল পিংকি রহমানের। সোফায় নিজের মাথা এলিয়ে দিয়ে সে আর্তনাদ করে উঠায় রুমা বেশ চেঁচিয়ে উঠলো।
“উল্লাসীর স্বামী? মানে উল্লাসী বিবাহিত? অসম্ভব! উল্লাসীর উনি দুঃসম্পর্কের ভাই হন। আর বিয়ের জন্য পাত্রী উল্লাসী উনার জন্যই খুঁজছে? এই বুড়ো ধামরার জন্য না।”
শীতলের কথা আসতেই সমান সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন মুন্নি সরকার।
“থাপ্পড় দিয়ে বত্রিশ দাঁত ফেলবো তোমার। কাকে ধামরা বলছো তুমি? খুব গলার জোর হয়েছে তোমার? আমার বাড়িতে এসে গলাবাজি করো? মিথ্যা বলার জায়গা পাওনা?”
“আমি কেনো মিথ্যা বলবো? আমাদের পুরো ক্লাস জানে এব্যাপারে৷ বিশ্বাস না হলে উল্লাসীকেই ডাকুন। ওই জবাব দিক উনি ওর দুঃসম্পর্কের ভাই কীনা!”
পুরো পরিস্থিতি বোধগম্য না হলেও পাপিয়া অসহায় মুখে তাকালো শীতলের দিকে। ঢোক চেপে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনি কি ডাক্তার নন?”
জবাবে ঘাড় নাড়লো শীতল।
“তাহলে কী করেন আপনি? কিছুই কি করেন না?”
রুমার নাম্বার থেকে আসা ম্যাসেজ পেয়েই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছিল উল্লাসীর। একরাশ অস্থিরতায় দিশেহারা বোধ করতেই একদন্ড আর অপেক্ষা না করে ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি ঘোরাতে বলেছিল। শীতল নামের বলদ লোকটার উপর কত সহজেই না ভরসা করে কোচিংয়ের জন্য রওনা হয়েছিল সে। অথচ লোকটি কিনা কিছুই করতে পারলো না! ভেবে নিজের উপর প্রচুর রাগও হচ্ছিলো। সে চাইলে পুরো ঘটনা মুন্নি সরকারকে খুলে বলতে পারতো। তা না করে কেনো শীতলের উপর ভরসা করলো সে? লিফট থেকে বেরিয়ে ধাপধুপ করে দৌড়ে মুন্নি সরকারদের দরজার কাছে আসতেই পুরো শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো উল্লাসীর। মনেমনে কয়েকবার আল্লাহর নাম আউড়ে সে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল মেসবাহর নিরুপায় দৃষ্টি। মাথা ঝুকে মেঝের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রয়েছে সে।
“এসেছো তাহলে তুমি! বেয়াদব মেয়ে একটা। তোমার এত বড় সাহস? আমার সাথে এত বড় ফাতড়ামি! নিজের স্বামীকে ভাই বানিয়ে কোচিংয়ে ফষ্টিনষ্টি করে যখন মন ভরে না তখন নিজের স্বামীর জন্য পাত্রী খোঁজো! ছিঃ! ছিঃ! জামাইকে ভাই বানাতে বুক কাঁপেনা তোমার? মনে আল্লাহর ভয় নেই?”
উল্লাসীর উপর প্রচুর মেজাজ খারাপ হলেও উল্লাসীকে নিয়ে বাজে কথা শুনেও মেজাজ আরও চড়াও হলো মুন্নি সরকারের। পিংকি রহমানের উদ্দেশ্যে সে দাপট নিয়ে বললেন,
“উল্লাসীকে নিয়ে কী বলছেন এসব? ওকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে আপনার জিহ্ব আমি ছিঁড়ে ফেলবো।”
“ছেঁড়েন.. সাহস থাকলে ছিঁড়ে দেখান।”
পিংকি রহমান হা করতেই সেদিকে এগিয়ে গেলেন মুন্নি সরকার। কোমড়ে আঁচল গুঁজে পিংকি রহমানের জিহ্ব টেনে ধরতেই পাশ থেকে সকলেই চিৎকার করে উঠে থামানোর চেষ্টা করলো দুজনের মাঝের যুদ্ধকে।
অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভবে মেসবাহ উপস্থিত থাকলেও শেষটা দেখতে আর দাঁড়ালো না সে। হন্য পায়ে সে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে ছুটতেই তার পিছু নিল উল্লাসী।
“শুনুন.. শুনুন না! আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আর হবে না এমনটা।”
মেসবাহর পিছুপিছু উল্লাসী ক্ষমা চাইতে চাইতে ফ্ল্যাটে ঢুকলেও তাদের শোবার ঘরে তাকে ঢুকতে বাঁধা দিল মেসবাহ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে বললো,
“যা শোনার পরে শুনবো। আপাতত তুমি এখান থেকে যাও।”
“আমি গেলেই কি ঝামেলা মিটে যাবে?”
“যাবে.. তুমি যাও।”
“আপনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ কেনো করছেন? আমি বারবার স্যরি বলছি না?”
মেজাজ ক্রমশ বিগড়ে যাচ্ছে বুঝে নিজেকে শান্ত করতে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো মেসবাহ। তারপর বেশ ঠান্ডা গলায় বললো,
“আমাকে খানিকটা সময় দাও উল্লাসী। আমি গরম মাথায় এনিয়ে কথা বলে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। তুমি বরং ওখানে যাও। আর যে ঝামেলা বাঁধিয়েছো তা মেটাও। মানুষের জীবনকে খেলনা বানিয়ে তা দিয়ে খেলার বয়স তোমার নেই।”
“কার জীবন নিয়ে খেললাম আমি? আপনি এভাবে কেনো বলছেন যেনো আমি শীতল ভাইয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি?”
অশান্ত সুরে বললো উল্লাসী। তবে মেসবাহর দিক থেকে কোনো সাঁড়া না পেয়ে গলা খানিকটা কঠিন করলো সে।
“আপনি করলে ইটস ফাইন। আর আমি করলে অন্যের জীবন নষ্ট? সমস্যা কী আপনার? আপনি আমাকে দুঃসম্পর্কের বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন না? তাহলে আজ আমি তা করলে দোষ কোথায়?”
“দোষ আছে তোমার উল্লাসী।”
“তাহলে সেদিন আপনারও দোষ ছিল। আর আজ আমি করলাম। ব্যস! কাটাকাটি।”
“বাচ্চাদের মতো ব্যস বললেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যায় না। তুমি যে শীতল, মুন্নি ভাবিকে হার্ট করেছো তা তুমি বুঝতে পারছো? আমারটা না হয় বাদ দিলাম..”
“আমি ওদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব।”
উল্লাসীর মাঝে বিন্দুমাত্র অনুতাপ না দেখতে পেয়ে গলার স্বর কঠিন হয়ে এল মেসবাহর।
“খুব সহজ না? খুব সহজ সব কিছু? পড়ে ছিলে না কোন অজপাড়াগাঁতে। উঠে আসতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়েছে?”
হতভম্ব হয়ে পড়লো উল্লাসী।
“আপনি যা বললেন তা আবারও বলুন।”
“তুমি এখান থেকে যাও উল্লাসী।”
“আমি কোথাও যাবোনা। আপনি এভাবে খোঁটা দিয়ে কথা আমায় বলতে পারলেন? আপনি তো আগে এমন ছিলেন না!”
কাঁদোকাঁদো গলায় বলে উঠলো উল্লাসী।
“তুমিও আগে এমন ছিলে না উল্লাসী।”
দরজা ছেড়ে বিছানায় এসে বসলো মেসবাহ। বুকের ভেতরটায় তার বড়সড় এক তুফান বয়ে যাচ্ছে। উল্লাসীর করা কাজটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে।
“তুমি এখন আর ছোট নেই যে আশপাশটা দেখে শিক্ষা নেবে না। চৈতালিকে দেখছো না? ওর অবস্থাটা বুঝতে পারছো না? চৈতালি কোন দিক থেকে তোমার চেয়ে কম? তারপরও কেনো ওর জীবনটা আজ থমকে দাঁড়িয়েছে?”
উল্লাসীর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুড়ে পুরো মুখের ঘাম মুছে নিল মেসবাহ। ছোট কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও বললো,
“আমিই কেনো তোমায় সবসময় বুঝে যাবো? তুমি কেনো আমাকে, আমার মনকে বোঝার চেষ্টা করবে না? তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো। এ বয়সের অনেক মেয়ের বিয়েও হয়েছে। সেখানে তুমি নিজেকে অবিবাহিত বানানো চেষ্টায় আজ আমাকে হার্ট করলে। আর এবিষয়ে আমি কিছু বলতেও পারবো না? কোনো রিয়াক্টও করতে পারবো না?”
দরজার বাইরে থেকেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী।
“আপনিও তো আমাকে হার্ট করেছিলেন। আপনিও তো আমাকে বোন বানিয়েছিলেন। তাহলে আজ আপনি এত কথা আমাকে কোন মুখে শোনাচ্ছেন? আমার সাথে করছেন চৈতালির তুলনা? কী মনে হয় আপনার? আপনি না থাকলে আমি আজ এখানে আসতে পারতাম না? তাহলে একবার সুহার দিকে তাকান। সুহা আমার চেয়ে একশগুণ বেশি ভালো আছে। আমিও থাকতাম.. আজ এত দায়িত্ব ঘাড়ে না থাকলে আমিও আর দশটা মেয়ের মতো স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে পারতাম। আমার নানাজান আপনার চেয়ে আমাকে বেশি ভালো রাখতো। কোন কুক্ষণে যে আপনার সাথে বিয়ে হয়ে গেল আমার!”
উল্লাসীর কথা শেষ না হতেই উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। মাথার পেছনের অংশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলেও তা উপেক্ষা করেই দ্রুত পায়ে উল্লাসীর দিকে এগুলো সে। উল্লাসীর হাতটি শক্ত করে ধরে তাকে সদর দরজার বাইরে এনে দৃঢ় গলায় বললো,
“যাও.. স্বাধীন করে দিলাম। নানাজানের কাছে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো চলো। যাকে খুশি তাকে ভাই বা স্বামী বানাও। গাড়ি নিচে আছে। চলে যাও।”
(চলবে)