আবর্তন

আবর্তন !! Part- 03

চন্দ্রা ঘামার সাথে সাথে আবার কাঁপছেও! দাঁতে দাঁত ধাক্কা লাগছে।
কীভাবে সামাল দিবে এই পরিস্থিতি!
চন্দ্রা নিজের অস্তিত্ব নিজেই অনূভব করতে পারছেনা। চন্দ্রার জীবনে এই জঘন্য কাজটার জন্য এতো বড় শাস্তি পাবে কল্পনাও করতে পারেনি।
এদিকে সে এখান থেকে যেতেও পারছেনা, আবার স্থির থাকতেও পারছেনা। ইতোমধ্যে সে এই মহিলাটার গলায় শুনতে পেলো তিনি বলছে..
___ আমি যতটা জানি এই পুরো নাটকটা একটা মেয়ে করিয়েছে, সে আমার মেয়েকে টাকা দিয়ে রাজী করালো, আমার মেয়ের তো কোনো দোষ নেই জনাব, সে তো মাত্র কয়েকটা টাকার জন্য অভিনয় করতে রাজী হয়ে গিয়েছিলো। আমরা গরীব মানুষ, পেটেভাতে কোনো রকম দিন কাটাই ৷ ইদানীং আমাদের অবস্থা আরো খারাপ যাচ্ছিলো, গার্মেন্টস থেকে আমার মেয়ে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছিলোনা, যার জন্য সে ওই মেয়ের কথায় এই ছেলেটা সম্পর্কে বাজে কথা বলেছে। তাকে যা যা বলতে বলা হয়েছে সে ঠিক তাই তাই বলেছে। আমাদেরকে প্লিজ মাফ করে দিয়েন৷ এটা করতে আমার মেয়েকে বাধ্য করা হয়েছে!
চন্দ্রার বাবা মহিলাকে থামিয়ে বললো,
___ আপনাকে মাফ চাইতে হবেনা। আপনি শুধু এই ঘটনার সাথে জড়িত আসল মেয়েটার নাম বলুন, তাকে আমি জীবনের শিক্ষা দিবো। দু দুটো বাড়ির সম্মান নিয়ে খেলা করার মজা আমি বের করবো। নাম বলুন জলদি আর ঠিকানা জানা থাকলে ঠিকানা দিন। কতো বড় কলিজা দেখে নিবো! সে কেমন পরিবারের মেয়ে হয়ে এই কাজ করেছে আমি জাস্ট দেখতে চাই।
বলেই তিনি থামলেন!

এদিকে আড়াল থেকে চন্দ্রা এবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে৷ নাহ শ্বাস কেমন যেন আঁটকে আসছে। শরীর অবশ হয়ে আপনাআপনি চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। নির্ঘাত আজকে সে একেবারে শেষ! অরুণের কাছে যতটা অপরাধী তার চেয়েও বেশি নিজের বাবার কাছে অপরাধী হয়ে গেলো। উনার নিজের মেয়ে এই কাজ করেছে শুনলে কতটা ভয়ানক অবস্থা হতে পারে চন্দ্রা কল্পনা করতে পারছেনা৷
ঠিক তখন সেই মহিলা অনুনয় করে বললো,
___ জ্বি না, আমি মেয়েটার চেহেরা দেখতে পাইনি। শুধু আমার মেয়ের সাথে কথা বলার সময় দূর থেকে একটু চোখ দেখেছিলাম, মেয়েটা বোরকা পরে ছিল।
সে কোথা থেকে এসেছে কিংবা বাসা কোথায় কিছুই জানিনা। এদিকে আমার কাছে কোনো মোবাইলও নেই যে আমার মেয়েকে খবর দিয়ে আনতে পারবো। এমনকি আমার মেয়ের নাম্বারও আমার জানা নেই, আমি এসব মোবাইলের ব্যাপারে কিছু বুঝিওনা। সে না আসা পর্যন্ত আমি কিছু বলতে পারবোনা। দয়া করে আমাদের কোনো ক্ষতি করবেন না, বিষয়টা পুলিশে জানাবেন না। আমার বিনীত অনুরোধ রইলো!
বলেই মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলো। চন্দ্রার বাবা এবং অরুণের মা-বাবাও উনাকে আশ্বস্ত করলেন। অতঃপর উনাকে কিছু টাকা দিয়ে চলে যেতে বললো, আর বলে দিলো তার মেয়ে আসার সাথে সাথে যেন এখানে এনে উপস্থিত করে।
চন্দ্রার ভাবী এতক্ষণে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা ছোট হাসি দিলো। উনার এই হাসির মানে হলো এইবারের ঝড়ে চন্দ্রা বেঁচে গেছে। কিন্তু চন্দ্রার ভেতরের সেই ঝড় থামছেনা। কারণ ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাওয়ার নয়৷ অরুণের পরিবার থেমে গেলেও, চন্দ্রা তার বাবাকে হারে হারে চিনে, তিনি এর শেষ দেখেই ছাড়বেন।

চন্দ্রা চুপচাপ এখান থেকে সরে নিজের রুমে গেলো। নাহহ তার কিছুতেই শান্তি লাগছেনা, মনে হচ্ছে ভয়ে তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কীভাবে এই সত্য লুকাবে চন্দ্রা, তার মাথা কাজ করছেনা৷ নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে প্রথমে ভাবলো বিষয়টা রনিকে জানানো দরকার। কেন জানি বাড়ির সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। এই মুখ নিয়ে তার বাবার সামনে সে যেতে পারবেনা। কোনোভাবেই না।
কিন্তু পরক্ষণে ভাবলো,,রনিকে ফোন দিয়ে তো কোনো লাভ নেই, সেতো তাকে নিয়ে পালিয়েও যেতে পারবেনা। বিয়েও করতে পারবেনা এখন। তার এখন এমন কোনো যোগ্যতা কিংবা দুঃসাহস কোনোটাই হয়নি।
চন্দ্রা নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা, অদ্ভুত হতাশা আর ভয় তাকে এতো তীব্রভাবে চেপে ধরেছে যে, সে কিছুতেই নিজেকে আস্বস্ত করতে পারছেনা। মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে তার কলিজাটা ফেটে যাবে, কি ভয়ানক যন্ত্রণা সেখানে!
নিজের এতো বড় ভুল আর কার্যকলাপের কথা মনে হতেই নিজের উপর তার অনুশোচনা হচ্ছে। কেন যে এমন কাজ করতে গেলো, আর গেলো তো গেলোই এই অরুণের কাছে সে বাজেভাবে ফেঁসে গেলো! এই বিষয়টা নিয়ে অরুণ আর ঘাটাঘাটি না করলে তো তার উপর এতো বড় বিপদ নেমে আসতো না।
তার এমন চিন্তা আর নিজের উপর নিজের ক্ষোভের মধ্যে কতটা সময় কেটে গেলো সে বুঝতে পারলোনা।
হঠাৎই তার ভাবী রুমে এসে আশ্চর্য হাসির রেখা টানিয়ে দুলতে দুলতে বললো,
___কিছুক্ষণ পরে আপনার বিয়ে হচ্ছে চন্দ্রাবতী,প্রস্তুত হন। অতি চালাকি করতে গিয়েছিলেন না আপনি? এবার ঠেলা নিয়েন। টা,টা!
বলেই চন্দ্রার ভাবী রুম থেকে যাওয়ার উদ্যত হলো, চন্দ্রা আতঙ্ক মাখানো কণ্ঠে বললো,
___মানে কি ভাবী? কিসের বিয়ে,আর কার বিয়ে? আজব এখানে আজ বিয়ে কোথা থেকে আসবে? পাগল হয়ে গেছো তুমি?
তার ভাবী ঘুরে তাকিয়ে বললো,

___বিয়ের যত কেনাকাটা ছিল সব ওরা সাথে নিয়ে আসছে, কাজী ডেকে এখনি বিয়ে হবে। আর কোনো নাটক সাজানোর সময় দিবেনা বুঝেছো? দরকার হলে পরে অনুষ্ঠান করবে! তোমার বাবা মানে আমার শশুড় এটাই চাচ্ছেন এই মূহুর্তেই বিয়ে হোক, আমি যাচ্ছি কারণ মাছগুলো পাশের বাসার ভাবীকে বানিয়ে দেওয়ার জন্য দিয়ে আসতে হবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! এখন তো বিয়ের আয়োজন করতে হবে তাইনা?!
বলে তিনি চলে গিয়েও ফিরে এসে বিছানা থেকে চন্দ্রার ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
___এটা আমার কাছে রাখলাম। উল্টা পাল্টা কিছু করার চিন্তা মাথায় এনোনা। নাহলে সত্যিটা বাবাকে বলে দিবো!
বলেই হনহন করে তিনি বেড়িয়ে গেলেন। চন্দ্রা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো, মাথা পুরো আউলা হয়ে গেছে, একদিকে এতো বড় বিপদ অন্যদিকে নাকি বিয়ে হতে যাচ্ছে আবার এখন ফোনটাও তার ভাবী নিয়ে গেলো। এখন সে রনিকে এই ব্যাপারে কি করে জানাবে? উফফ! তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে, সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, নিজের এই ভুলের মাশুল তাকে কড়ায়গণ্ডায় পেতে হবে।

তবে আর যাই হোক এই বিয়ে করা অসম্ভব। রনিকে না ছাড়া সে নিজেকে অন্য কারো সাথে ভুলেও ভাবতে পারেনা। দরকার হলে সত্যিই মরে যাবে! কোথা থেকে জানি একটা শয়তান তার কাঁধে চেপে বসেছে,শুধু মরে যাওয়ার কথা মাথায় আসতেছে। অন্যদিকে তার খেয়াল হলো, সে মরে গেলে রনি তো অন্য কারো সাথে প্রেম করবে এবং বিয়ে করবে। না না এটা হতে দেওয়া যাবেনা। তাকে বাঁচতে হবে, এবং যে করেই হোক এই বিপদ মোকাবিলা করতে হবে।
রুমের এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলো,আর দাঁত দিয়ে নিজের হাতের নখ কামড়াতে লাগলো।
হঠাৎ চন্দ্রা থেমে গেলো, মাথায় দারুণ একটা আইডিয়া এসেছে। কীভাবে কি করা যায় সেটা ভাবতে লাগলো,,আর ঠিক সেসময় পেছনে তার কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে সে হুড়মুড় করে লাফিয়ে পেছনে তাকালো। পেছনে তাকানোর সাথে সাথে বাঘ দেখার মতো আরেক লাফে তিনহাত দূরে সরে গেলো। তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললো,
___এখানে আপনি? আপনি এখানে কেন? কি করে এলেন?আপনার এতো সাহস কীভাবে হতে পারে? আম্মু,আব্বু কোথায় তোমরা?
আরেকটু জোরে চেঁচানোর আগেই তার মুখে অরুণ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। চন্দ্রা হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলে অরুণ আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বললো,
___সাহস তো আমার চাইতে তোমার বেশি চন্দ্রা! খুব বেশিই অভিনয় করে ফেলেছো, বিয়েরদিন সবার সামনে তোমার অভিনয়ের কি অসাধারণ ভঙ্গিমা-ই না ছিল! শুনো আমি সেই তুলনায় এখনো কিছুই করিনি তবে একটা নির্দোষ ছেলেসহ তার পরিবারকে চরমভাবে অপমানিত করার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে এবং পেতেই হবে!
চলবে….