অচেনা আমি ! পর্বঃ- ৮
লেখাঃ শারমিন আক্তার
সকালে ফজরের আযানের সময় তনয়ার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখে আয়াত ওর পাশেই আঁধা শোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। তনয়া মনে মনে বললো স্যরি আয়াত, আমার জন্য তোমার এত কষ্ট করতে হচ্ছে। যদি সত্যিই রায়হান সেই ছেলেটা হয় তবে রায়হানকে আমি ছাড়বো না। তনয়া উঠে ওযু করে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলো। আয়াতকে ঘুম থেকে ডেকে বললো আয়াত উঠে নামাজ পড়ে নাও তারপর চাইলে আবার ঘুমাও। আয়াত নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পরলো কারন সারা রাত না ঘুমানোর কারনে শরীর বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
সকাল নয়টার দিকে ফোনের রিংটনে ঘুম ভাঙলো আয়াতের। আয়াত ফোনটা রিসিভ করে বললো হ্যা মেহেদী (আয়াতের বন্ধু) তুই এসে গেছিস?
মেহেদীঃ হ্যা মাত্র কুয়াকাটা আসলাম এখন কি তোদের হোটেলে আসবো?
আয়াতঃ না না, তুই কোথায় বল আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি।
মেহেদীঃ একটা খাবার রেস্তোরার নাম বললো।
আয়াত রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে তনয়া বিছানার একপাশে বসে একটা বই পড়ছে।
আয়াতঃ তনয়া বাকি সবাই কি ঘুরতে গেছে?
তনয়াঃ হ্যা। আমাদের ডাকতে আসছিলো আমি না করে দিয়েছি বলছি তুমি ঘুম থেকে উঠলে তারপর আমরা যাবো।
আয়াতঃ ঠিক আছে । তুমি কি বের হবে নাকি রুমে বিশ্রাম নিবে? কারন আমাকে কিছুক্ষনের জন্য জরুরি কাজে যেতে হবে। ঘন্টা খানিকের মধ্যে ফিরে আসবো।
তনয়াঃ ঠিক আছে তুমি যাও আমি রুমেই থাকি। বের হতে ইচ্ছা করছে না।
আয়াতঃ হুমমমম। তবে সাবধানে থেকো। আর কিছু দরকার হলে আমায় ফোন করো কেমন?
আয়াত তনয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেহেদীর সাথে দেখা করতে গেলো। মেহেদীকে দেখে আয়াত বললো কিরে যা যা জানতে বলেছিলাম জেনেছিস তো ঠিক ভাবে?
মেহেদীঃ তুই কাল রাতে বলার পরই সব খবর নিয়েছি। আর সকালে নামাজ পড়েই রওনা দিলাম, সকালে রাস্তাঘাট ফাঁকা তাই আসতে কোন সমস্যা হয়নি।
আয়াতঃ বল কি জানলি রায়হান আর জয়ের বিষয়ে ?
মেহেদীঃ জয়ের বিষয়ে তেনি কিছুই জানানোর নাই। আগের মতই সব কিছু। এইচ এস সি কমপ্লিট করে তুই ডাক্তারিতে ডুকে গেলি আর জয় অর্নাসে পড়াকালীন সময় মানে ২য় বর্ষে বসে আই পি এস এক্সাম দিয়ে চান্স পেয়ে চায়। পরে ভালো পজিসনেই পরে গতবার প্রোমোশন হয় আর কয়মাস আগে বদলি হয়ে তোদের ওখানে যায়। শুনেছি মাস ছয় আগে বিয়ে করেছে । সংসার বেশ সুখেই আছে।
আয়াতঃ আর রায়হানের বিষয়?
সেহেদীঃ রায়হান জয়ের চেয়ে প্রায় চার বছরের ছোট। কিন্তু বয়সে ছোট হলে কি হবে, মেধা শক্তি দারুন, একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তবে ছেলেটা কেমন পাগলাটে টাইপ। যতদূর শুনেছি মানুষিক ভাবে কিছুটা অসুস্থ ছেলেটা, যেটা ওর চাই সেটা চাইই চাই, যাকে ভালোবাসবে তাকে সবটা দিয়ে ভালোবাসবে আর যাকে ঘৃণা করবে তাকেও সবটা দিয়ে ঘৃণা করবে। আজব ছেলে মানুষের সাথে তেমন মেশে না। অনেকটা সাইকো টাইপ। কিন্তু মাস খানে ধরে নাকি একদম স্বাভাবিক আছে ওর পাড়ার লোক বললো। ঠিকমত নামাজ পড়ে, সবার সাথে কথাও বলে।
আয়াতঃ তুই এত তারাতারি এত কিছু কি করে জানলি?
মেহেদীঃ কামঅন আয়াত ভুলে গেলি আমি আর জয় একই এলাকার ছেলে। তো এসব কিছু জানাটা আমার কাছে তত কঠিন কিছু না।
আয়াতঃ আর ফোনের বিষয় কিছু জানিস?
মেহেদীঃ তোর সব কথা শুনে যতদূর আন্দাজ করতে পারছি তাতে এ কাজ রায়হান ছাড়া কেউ করতে পারে না। কারন রায়হানের সারাদিনের কাজই হচ্ছে কম্পিউটার, ইন্টারনেট এসব নিয়ে। তারপরও কোন কিছু প্রমান না করে কারো দিকে আঙুল তোলা ঠিক না। তাই সব কিছু খোঁজ খবর নিয়ে তারপরই ডিসিশন নিস।
আয়াতঃ হুমমম ঠিক বলছিস। চল হোটেলে চল। তোর ভাবি টেনশন করবে বেশি দেরী হলে এমননিতেই কাল রাতে রায়হানের আওয়াজ শোনার পর থেকে ভিষন ভয়ে আছে।
আয়াত হোটেলে গেলো, মেহেদী বিচে কিছুক্ষন থাকতে চাইলো। আয়াত রুমে ডুকে দেখে তনয়া বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। তা দেখে আয়াত জিগেস করলো কি হয়েছে তনয়া? শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে?
তনয়াঃ রায়হানের এসেছিলো!
আয়াতঃ হোয়াট? তনয়া কি বলেছে রায়হান?
তনয়াঃ তুমি যাবার বেশ কিছক্ষন পর আমার ফোনে একটা নাম্বার দিয়ে ফোন আসে। আমি ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিতেই অপর পাশ থেকে যেই তনয়া বলে ডাক দিলো আমি বুঝে গেলাম কে ফোন দিয়েছে? সে বললো তনয়া তোমার কাছে আমার পরিচয় লুকিয়ে এখন আর লাভ নাই কারন আমি জানি গতকাল রাতে তুমি আমার আওয়াজ শুনেই আমাকে চিনতে পারছো। তাই এখন লুকোচুরির কোন মানেই হয় না। তুমি বরং আয়াত আসলে বিকালে ওকে নিয়ে মেসেস এ পাঠানো ঠিকানায় আসো। ভয় পেও না আর তোমাদের ক্ষতি করবো না। চাইলে পুলিশ নিয়েও আসতে পারো।
আয়াত তনয়াকে বললো ঠিক আছে আমরা যাবো। বিকাল বেলা আয়াত তনয়াকে নিয়ে রায়হানের সাথে দেখা করতে গেলো। রায়হান বিচে পাশে একা দাড়িয়ে ছিলো। তনয়া ভয়ে আয়াতের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো। ওদের দেখে রায়হান বলা শুরু করলো
রায়হানঃ ঠিক কি দিয়ে কথা বলা শুরু করবো ভেবে পাচ্ছি না, কারন আমি অন্যায়ই এমন করেছি যে, ক্ষমা চাইবার যোগ্য নই তবুও পারলে ক্ষমা করে দিয়েন প্লিজ।
আয়াতঃ কিন্তু তুমি এসব কেন করলে রায়হান?
রায়হানঃ আসলে কয়েকমাস আগে থেকে আমি তনয়ার গল্প পড়তে পড়তে ওর গল্পের ভিতর এতটা ডুবে গিয়েছিলমে যে, না চাইতেও তনয়াকে ভালোবেসে ফেলি। একটা মেয়েদের ফেইক আইডি দিয়ে তনয়ার সাথে অনেকদিন চ্যাটিং করি, তাতে এটা জানতে ও বুঝতে পারি যে তনয়া আপনাকে খুব সম্মান করে ও অনেক ভালোবাসে। তারপর বিভিন্ন ভাবে তনয়ার মনে আপনাকে নিয়ে সন্দেহ ডুকাতে চাইতাম কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যার্থ হতাম। ভিষন রাগ হতো, তনয়া আপনার কথা বললে ভিষন ঘৃণা হতো আপনার প্রতি। কিন্তু তখনও তনয়াকে চিনতাম না।
আয়াতঃ সেটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু কি করে বুঝলে যে এটাই তনয়া আর আস্ফির সাথে সম্পর্ক হলো কি করে
রায়হানঃ কমাস আগে যখন আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম তখন কথায় কথায় আস্ফি আমার কাছ থেকে আমার ফেইসবুক আইডির নাম জেনে নেয়। তারপর ওর একটা আইডি থেকে টুকি টাকি কথা হতে থাকে, ও কখনো বলেনি আপনার স্ত্রীর নাম বা সে লেখালেখি করে হয়তো প্রয়োজন হয়নি তাই। তারপর মাস দুই আগে এতদিন আস্ফি ওর রিয়াল আইডি দিলো তখন আস্ফির মিউচুয়াল ফ্রেন্ড তনয়াকে দেখে জিগেস করলাম তনয়াকে চিনে কিনা? আস্ফি বললো তনয়া ওর নিজের ভাবি। যাকে এতদিন ধরে আমি খুঁজছিলাম সে আমাদের এত পরিচিত? ভাবতেই অবাক লাগলো। তারপর আপনার হসপিটাল থেকে আপনার নাম্বার পাই আর তনয়ার নাম্বারটা আস্ফির ফোন থেকে নেই।
আয়াতঃ কিন্তু আস্ফি তো বললো ওর সাথে তোমার এই দ্বিতীয়বার দেখা ! এর আগে তোমরা কখনো দেখা করোনি।
রায়হানঃ আস্ফি সত্যিই বলছে। আসলে দু মাস আগে আস্ফির ফোনটা চুরি হয়ে গেছিলো সেটা আমি চুরি করিয়েছিলাম। তার পরের ঘটনা আপনারা জানেন।
তনয়াঃ সব কিছু জেনেও আমার আয়াতকে ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন কেন? তারপর হঠাৎ করে ফোন দেয়া কেন বন্ধ করলেন?
রায়হানঃ নিজের ভুল বুঝতে পেরে। মনে আছে একদিন রাতে তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম তখন তুমি রাগ করে আমায় অনেক কথা বলেছিলে। তখন ভুল বসতো তুমি ফোন কাটোনি, তো তার কারনে আয়াত আর তোমার মধ্যে হওয়া সব কথা শুনতে পেয়েছিলাম। তোমাদের বেবির কথাও। তখন কেনো যেনো নিজের ভিতর অপরাধ বোধ তৈরী হয়েছিলো। আমি নিজের জানামতে কখনো কারো ক্ষতি করিনি কিন্তু সেদিন তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো তিনটা জীবন নষ্ট করতে চাচ্ছি নিজের পাগলামির কারনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন নিজের মাঝে দেখতে পেলাম। তনয়া একটা পোষ্টে বলেছিলো যখন মন অস্থির লাগে তখন আল্লাহর নাম নিয়ে নফল নামাজ পড়লে নাকি সব অস্থিরতার অবসান হয়। আমিও সেটাই করেছি। পরে নিজের মনই আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। সেদিন থেকে কেনো যেনো তনয়ার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তনয়ার একটা কথা কানে বাজে যাকে ভালোবাসেন তার সাথে জড়িত প্রতিটা জিনিসকে এবং মানুষকে ভালোবাসতে হয়, এমনকি তার না কেও ভালোবাসতে হয়।
তনয়াঃ তাহলে আয়াতের কেন ক্ষতি করছো?
রায়হানঃ সত্যি বলতে ওটা দূর্ঘটনা ছিলো, কারন আমি শুধু আয়াতকে আঘাত করতে চেয়েছিলাম তাও আয়াতের চেম্বারে বসে বা ও বাইরে বের হলে কিন্তু কিভাবে যেনো, সেদিন কাকতালীয় ভাবে ঐ দূর্ঘটনাটা ঘটে গেলো। বিশ্বাস করো আর না করো তবে এটাই সত্যি যে, ঐ ঘটনার পিছনে আমার কোন হাত নাই। তবে ঐ ঘটনা সম্পর্কে তোমাদের যা বলেছি সব তোমাদের ভয় দেখানোর জন্য। আমি সবসময় তোমাদের জীবনে #অচেনা_আমি হয়ে থাকতে চেয়েছিলা কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা অন্য কিছু ছিলো তাই না চাইতেও কুয়াকাটায় আপনাদের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
আয়াতঃ আর আস্ফির কি হবে?
রায়হানঃ আমি আস্ফিকে সব সত্যি দুপুরে বলে দিছি। আসলে আমি আস্ফিকে সবসময় আমার ভালো বন্ধু হিসাবে দেখেছি জানিনা আস্ফি কিভাবে আমাকে পছন্দ করে বসলো! হয়তো কদিন কান্না কাটি করবে তবে আপনাদের মত ফ্যামিলি যার পাশে আছে তার কোন সমস্যা হতে পারে না। আপনারা চাইলে আমাকে পুলিশে দিতে পারেন, বা জয় ভাইয়াকে সব বলতে পারেন! সে এসব বিষয় কিছুই জানে না। আপনাদের কেসটার কথা ভাইয়া আমার সাথে আলোচনা করেছিলো আমিই বলেছিলাম এটা খুঁজে বের করা পছিবল না।। আমি নিজের ভুল বোঝার পর থেকে ভিষন অনুতপ্ত হচ্ছি, একদিনও শান্তি পাচ্ছি না। নিজের ভুল বোঝার আগে তনয়াকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান পর্যন্ত বানিয়েছিলাম কিন্তু এখন নিজের কর্মের কথা ভেবে নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। তবে হ্যা তনয়া তোমায় ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর সারা জীবন ভালোবাসবো । নতুন অতীথির জন্য দোয়া রইলো, তোমাকে দেখার আফসুস সারা জীবন মনের ভিতর থাকবে। তবে ভেবো না আর তোমাদের জীবনে #অচেনা_আমি হয়ে ফিরে আসবো না। ভালো থেকো। পারলে ক্ষমা করে দিও।
রায়হান চলে যাচ্ছে তনয়া আয়াত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সূর্যটা পশ্চিম দিকে ডুব দিবে দিবে ভাব হচ্ছে। হয়তো আজ সূর্যটা অস্ত যাবার পর কাল সকালে যে, সূর্যটা উদিত হবে সেটা বয়ে আনবে সোনালী সকাল। যেখানে থাকবে না কোন কালো ছায়া।
তনয়া রায়হানকে পুলিশে দিতে চাইলেও আয়াত মাফ করে দেয় কারন আয়াতের মতে অনুতাপ আর অনুসূচনার চেয়ে বড় কোন শাস্তি হতে পারে না। সবার ভালোবাসায় আর সহমর্মিতায় আস্ফি অল্প দিনেই স্বাভাবিক হয়ে উঠলো।
তনয়া বর্তমানে নয় মাসের গর্ভবতী যে কোন সময় যে কোন দিন নতুন অতীথির আগমন ঘটবে। তনয়া বেলকানিতে দাড়িয়ে ডুবন্ত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো , জীবন কত বিচিত্রময়, কেউ জনম জনম দেখে জেনে শুনেও ভালোবাসতে পারে না আবার কেউ মাত্র তার কিছু জিনিস পেয়ে, তার লেখা পড়েও তাকে পাগলের মত ভালোবেসে ফেলে। রায়হান আমাদের জীবনে অচেনা আমি হয়ে এসেছিলো কিন্তু তার চেনা অনেক ছাপ রেখে গেছে আমাদের জীবনে। কিন্তু আমি চাই ও সারা জীবন আমাদের জন্য #অচেনা_আমি হয়েই থাকুক। আমার জীবন বলতে তো আমার আয়াত।
আয়াতঃ নাহ আমাদের জীবন বলতে যে আসছে সে।
তনয়াঃ নাহ । ইউ অলেয়েজ বি মাই লাইফ এন্ড মাই লাভ।
সমাপ্ত
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন
গল্পটা কেমন লাগলো জানাবেন
ভাল ছিল।