অনাকাঙ্ক্ষিত সে

অনাকাঙ্ক্ষিত সে !! Part- 02

বাংলো বাড়ির গেটের সামনে যেতেই নুয়াজ হাত উঠিয়ে ইশারা করছে। এই মুহুর্তে মিশ্মির কাছে বাংলো বাড়িটা মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। নুয়াজ হাসতে হাসতে মিশ্মির দিকে এগিয়ে আসে। বিশ্বজয় করলে যতটা খুশি হওয়া যায় ততটাই খুশির ছাপ দেখা যাচ্ছে নুয়াজের চেহারায়। খুশি হবেই না বা কেন? এতগুলো সময় যার পিছনে নষ্ট করল কিন্তু কোনো পাত্তাই পায়নি আর সেই পাখি’ই যখন নিজের ইচ্ছায় খাঁচায় আসে তখন খুশি হওয়াটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।
নুয়াজ মিশ্মির কাছে এসে বলে,
“কতক্ষণ ধরে তোমার জন্য ওয়েট করছি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।”
মিশ্মি ঠিক বুঝলো না নুয়াজ কোন ক্ষুধার কথা বলল। পেটের ক্ষুধা নাকি শরীরের ক্ষুধা নুয়াজই ভালো জানে। এক দৃষ্টিতে নুয়াজের দিকে তাকিয়ে আছে মিশ্মি। নুয়াজ হাত নাড়িয়ে বলে,
“কোথায় হারিয়ে গেলে? ভেতরে চলো। ঠান্ডা লাগছে খুব।”
“হু।”
নুয়াজ সামনে সামনে হাঁটছে আর মিশ্মি পিছনে পিছনে। এক হাতের মত দূরত্ব হবে। আর কিছুক্ষণ পরই এই মানুষটা কত কাছে চলে আসবে! নুয়াজ দাঁড়িয়ে গেল। মিশ্মি নুয়াজের কাছে আসতেই নুয়াজ হাঁটা শুরু করল। পাশাপাশিই হাঁটছে দুজন। নুয়াজ বলল,
“তোমার ঠান্ডা লাগছে না?”
“না।”
“বাবারে! কি শরীর তোমার? সমস্যা নেই ঠান্ডা লাগলেও বা কি? আমি তো আছি গরম করার জন্য।”
বলেই বাঁকা হাসি হাসলো নুয়াজ। মিশ্মির ঘৃণায় শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। শরীরের লোমগুলো দাঁরিয়ে গিয়েছে।
রুমের ভেতর গিয়ে দরজা আটকে দেয় নুয়াজ। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে,
“বসো।”
মিশ্মি কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে। চারদিকে তাকিয়ে রুমটা দেখছে। নুয়াজ জ্যাকেট’টা খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শুয়ে থেকেই বলে,
“খেয়েছো রাতে?”
“না।”
“কেন?”
“এমনি।”
“তোমার কি এখনও মন খারাপ? আমি হাসপাতালে খবর নিয়েছি। অপারেশন তো সাক্সেসফুল হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হলেই হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। ততদিন হাসপাতালের যত খরচ লাগে আমি দিবো। তুমি টেনশন করছো কেন?”
নুয়াজের কথা শুনে মিশ্মি মনে মনে তাচ্ছিল্যভাবে হাসি।
“কত সহজ করে বলে দিলেন আমি তো আছিই! কিন্তু এই কথার মধ্যে নেই কোনো ভালোবাসা। আছে শুধু বিনিময়। শরীরের বিনিময়েই টাকাগুলো দিচ্ছেন।”
নুয়াজ শোয়া থেকে ওঠে বসে।
“এত চুপচাপ কেন মিশ্মি? কথা বলছ না কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
নুয়াজ টেবিল থেকে পানি নিয়ে মিশ্মির দিকে এগিয়ে দেয়।
“খাবো না।”
“আরে খাও। রিলাক্স লাগবে।”
মিশ্মির কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। তাই গ্লাসের পানিটুকু পান করে। নুয়াজ বলে,
“খাবার অর্ডার করি?”
মিশ্মির মনে হচ্ছে সে কোনো কুরবানির গরু। গরুকে হাঁটে উঠানোর আগে যেমন আদর-যত্ন করে খাওয়ানো হয় তেমনটাই করছে নুয়াজ। নিজেকে তো কুরবানি দিতেই হবে।
মিশ্মি দৃঢ় গলায় বলে,
“আমি খাব না।”
“তুমি কি আমার ওপর রেগে আছো?”
“আপনি প্লিজ কথা বলা অফ করুন। আমার ভালো লাগছেনা কিছু।”
নুয়াজ সাথে সাথে মিশ্মিকে বসা থেকে দাঁড় করায়। কোমরে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। গালে হাত বুলিয়ে বলে,
“খবরদার! আমার উপর রাগ দেখানোর চেষ্টা করো না। আদারওয়াইজ এখন থেকে তুমি আমার। সো আমি যা খুশি করতে পারি।”
মিশ্মি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। যেই মৃত্যুপুরীতে একবার পা রেখেছে সেখান থেকে বের হওয়া মিশ্মির মত মেয়ের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। মিশ্মির গায়ের ওড়না টান দিয়ে ফেলে দেয় নুয়াজ। বিছানায় শুইয়ে গলায় আর গালে হাত বুলিয়ে বলে,
“তোমার মনে আছে মিশ্মি, যতবার তোমায় ভালোবাসার কথা বলেছি ততবারই কিভাবে আমায় ফিরিয়ে দিয়েছো?”
মিশ্মি নুয়াজের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
“এখন নিশ্চয়ই সেগুলোর প্রতিশোধ নিচ্ছেন?”
নুয়াজ একটু শব্দ করে হাসলো।
“আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই মিশ্মি। আমি চাইলেই তোমায় তুলে আনতে পারতাম। আমি সেটা করিনি।আমি তোমার পিছনে যতটা সময় ব্যয় করেছি ততটা সময় কারো পিছনে ব্যয় করিনি। আর তার প্রয়োজনও পড়েনি। আমার প্রপোজাল পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। আর সেই চাঁদ নিজে তোমার কাছে ধরা দিয়েছিল। কিন্তু তুমি তার মর্ম বুঝোনি। তোমাকে আমি কথাও দিয়েছিলাম যে, তোমার সাথে আমি কখনো তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ফিজিক্যালে যাবো না। কিন্তু তুমি! তুমি তাও আমায় ভালোবাসোনি।”
“হাহ্! যেই মানুষ একটা মেয়ের বিপদকে দূর্বলতা করে বিছানায় নিয়ে আসতে পারে সেই লোক কি রিলেশন করে বিছানায় নিতে পারতো না?”
“তুমি বড্ড চালাক মিশ্মি। বড্ড চালাক! এজন্যই তোমাকে একদিন পস্তাতে হবে। আর যদি ফিজিক্যাল রিলেশনে যেতামও তাহলেও আমি তোমায় বিয়ে করতাম। একটা কথা কি জানো তুমি? ভালোবাসা পূর্ণতা পায় ফিজিক্যালের মাধ্যমে।”
“তাহলে এমন ভালোবাসায় আমি থুথু ছিটাই। ভালোবাসলেই বিয়ের আগে বিছানায় যেতে হবে? ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে? সেটা কখনো ভালোবাসার পর্যায়ে পড়েনা। ওটাকে বলে চাহিদা। ভালোবাসা মানে একে অপরকে সম্মান করা। চোখের ভরসায় ভালোবাসা উপলব্ধি করানো।”
“ধ্যাত! এই ডিজিটাল যুগে এসেও এমন ক্ষ্যাতমার্কা কথা বলছো? এরকম এখন অহরহ হচ্ছে রিলেশনে। তোমার মত ক্ষ্যাত এমন কয়জন আছে বলো তো?”
“তাহলে আল্লাহ্-এর কাছে আমি হাজার শুকরিয়া জানাই কারণ আমি ক্ষ্যাত। আধুনিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে যদি নিজের সম্মান হারাতে হয় তাহলে আমি বলবো আধুনিকতার ছোঁয়া আমি চাইনা। জানিনা কি এমন পাপ করেছিলাম যে কারণে আজ এত বড় পরীক্ষা দিতে হচ্ছে আমায়।”
কথাগুলো বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে মিশ্মি।
“তোমার সাথে কথা বলায় আমি পারবো না। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন? একটুও কষ্ট দিবো না জান।”
নুয়াজ মিশ্মির ঘারে ঠোঁটের ছোঁয়া দেয়। অন্য হাত দিয়ে গলায় স্লাইড করে। নুয়াজের প্রতিটা স্পর্শ মিশ্মির ভেতরের সত্ত্বাকে ঘৃণায় মেরে ফেলছে। অসহ্য লাগছে। চোখের কোণা বেয়ে পানি পড়ছে। মনে মনে হাজারবার চাইছে এটা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু মিশ্মি জানে, এই জাহান্নাম থেকে মিশ্মির মুক্তি নেই। তবে মনে মনে এটাও পণ করে নিয়েছে যেদিন ওর বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে আর নুয়াজের জীবনেও মিশ্মির প্রয়োজন শেষ হবে সেদিনই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে মিশ্মি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী মিশ্মির জন্য নয়।

মিশ্মির ফোন বেজে ওঠে। ফোন টেবিলের ওপর। মিশ্মি ওঠতে চাইলে নুয়াজ বাঁধা দেয়।
“উঁহু! এখন ফোন ধরা যাবেনা। আমার মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাবে।”
মিশ্মির চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। নুয়াজ গিয়ে ফোনটা বন্ধ করে রাখে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মিশ্মির দিকে।
.
হাসপাতাল থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে মোহনা। পাশ থেকে রেহেনুমা বেগম বলে,
“কিরে ফোন ধরে না?”
“না মা। এতক্ষণ রিং হলো। আর এখন ফোন বন্ধ বলছে।”
“এত রাতে মেয়েটা গেলো কই! হাসপাতালে তোর বাপরে একবার দেখতেও আইলো না।”
“জানিনা মা।”
রেহেনুমা বেগম আর কথা বাড়ালেন না।
.
.
সকাল ১০ টার দিকে হাসপাতালে আসে মিশ্মি। নুয়াজের ড্রাইভার পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। নুয়াজ তখনও ঘুমে। হাসপাতালের ভেতর ঢুকতেই মোহনা আর মাকে দেখতে পায়।
“আব্বু এখন কেমন আছে রে মোহনা?”
“আব্বু ভালে আছে ডক্টর বলছে। কিন্তু কাল এতবার ফোন দিলাম ধরিসনি কেন?”
“শুনিনি রে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আর ফোনে চার্জও ছিল না। সকালে উঠে দেখি ফোন বন্ধ হয়ে আছে।”
রেহেনুমা বেগম বলেন,
“তুই ছিলি কই রাতে? সেই যে গেলি আর তো আসলিও না হাসপাতালে। টাকা দিয়েই কি দায়িত্ব পালন করলি?”
“না মা! আসলে শাকিলা আমায় এমন অবস্থায় আসতে দেয়নি। বলেছে সকালে যাস। তাছাড়া আমি তো হাসপাতালে ফোন করে খবর নিয়েছিই।”
“তবুও আসা দরকার ছিল।”
মিশ্মি কথাটাকে কাটিয়ে বলে,
“তোমরা তো মনে হয় খাওনি এখনো? চলো ক্যান্টিন থেকে খাইয়ে আনি। আমারও খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”
মোহনা বলল,
“হ্যাঁ রে আপু। খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
“আচ্ছা চল।”
তিনজনেই একসাথে খেতে বসেছে। মোহনা আর রেহেনুমা বেগম খেলেও মিশ্মির গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি খুব। খাওয়ার মাঝে রেহেনুমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যাঁ রে মিশ্মি এতগুলো টাকা কোথায় পেলি? একটা, দুইটা টাকা তো নয় যে তুই ধার করবি। লাখ টাকার ধাক্কা ছিল। এত অল্প সময়ে এতগুলো টাকা কে দিলো তোকে?”
মিশ্মি মনে মনে ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। কখন না জানি মা টাকার কথা জিজ্ঞেস করে। মিশ্মির ভয়টাই সত্যি হলো। কিন্তু কি উত্তর দিবে মাকে?

সকালে অভি এসে নুয়াজকে ঘুম থেকে উঠায়। নুয়াজ ফ্রেশ হয়ে বের হতেই অভি বলে,
“কাজটা কি ঠিক করলি?”
নুয়াজ চুল ঠিক করতে করতে বলে,
“কোন কাজের কথা বলছিস?”
“আমি মিশ্মির কথা বলছি। এটা না করে কি ওর বিপদে সাহায্য করতে পারতি না? দেখতি এমনিতেই তোর ওপর ওর ভালোবাসা জন্ম নিতো।”
“ধুর! কবে ভালোবাসা জন্ম নিবে না নিবে তারই তো কোনো ঠিক নেই। তাছাড়া সুযোগের সদ্বব্যবহার কিভাবে করতে হয় সেটা এই নুয়াজ ভালো করেই জানে।”
“কাজটা তুই একদম ঠিক করিসনি।”
“চুপ কর। এত সাফাই গাইতে হবেনা তোর।”
“আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবি?”
“কি?”
“তুই কি মিশ্মিকে সত্যিই কখনো ভালোবেসেছিলি?”
অভির কথা শুনে নুয়াজ জোরে হাসতে লাগলো।
“এভাবে হাসছিস কেন?”
“এত মেয়ের সাথে রাত কাটাতে কাটাতে ভুলেই গিয়েছি ভালোবাসা কি! তবে যাই বলিস, ওর চোখে কি যেন আছে। কি এক নেশা! এক মাদকতা।”
“তার মানে অন্যান্য মেয়ের মত মিশ্মিও ছিল তোর টার্গেট?”
“কনফিউজড করার মত প্রশ্ন!”

চলবে..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *