অদৃশ্য ভালোবাসা অনুভূতি– পর্বঃ- ৩
–নিশীঃ আয়াত তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলা কেন?
আয়াতঃ হোয়াট? আমি কেন তোমাকে ধাক্কা দিবো?
নিশীঃ তাহলে আমি পড়ে গেলাম কিভাবে?
আয়াতঃ আজব! আমি কি ভাবে বলবো? তুমিই হাটার সময় খেয়াল করো না। আর আমার দোষ দেও। হয়তো নিজের পায়েই নিজে হোচট খেয়েছো!
নিশীঃ কিন্তু—–
দূর মসজিসদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযানের ধ্বনি। হঠাৎ আয়াতের মনে হলো শরীরের উপর থেকে হিম বাতাসের একটা স্রোত বয়ে গেলো। বাতাসের ঠান্ডা পরশে কারো যেনো ভালোবাসা ছিলো।
আয়াতঃ নিশী যাও নামাজ পড়ে নাও। আমিও নামাজ পড়ে আসি।
নিশীঃ হুমমম।
নামাজ পড়ে আয়াত বাগানে কিছুক্ষন হাটাহাটি করলো। কিন্তু মনটা পড়ে আছে বইটার ভিতরে। মনে হয় বইটা না পড়লে শান্তি পাবে না। কি গিফ্ট দিয়ে ছিলো আয়াত তনয়াকে? তনয়া কি নিজের ভালোবাসার কথা বলতে পারছিলো। আয়াত গল্পটার কথা ভাবছে আর সাথে ভাবছে গল্পের প্রতিটা কথা যেনো আমার পরিচিতো। মনে হয় ঘটনা গুলো আমার নিজের জীবনের সাথে ঘটেছে। আয়াত ছেলেটার চরিত্রের সাথে যেনো আমার নিজের মিল খুজে পাই। কিন্তু তনয়া! আমার স্মৃতির কোথাও তো তনয়া নামের কেউ নাই। তাহলে বার বার আমার এটা কেন মনে হচ্ছে ঐ গল্পের প্রতিটা কথা শব্দ বাক্য আমার চেনা! নাহ বইটা না পড়ে শান্তি পাচ্ছি না। আয়াত স্টাডি রুমে গিয়ে বইটা খুজতে লাগলো কিন্তু বইটা খুজে পাচ্ছে না।
আয়াতঃ একি বইটা এখানেই তো ছিলো । কোথায় গেলো? আয়াত বেশ কিছুক্ষন বইটা খুজে না পেয়ে হতাস হয়ে স্টাডি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর ভাবতে থাকলো বইটা কোথায় উধাও হয়ে গেলো?
আয়াত অফিসে যাবার পর নিশী বইটা বের করলো। আসলে বইটা নিশীই লুকিয়ে ফেলেছিলো। তারপর #বইটাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে দিলো। আর বললো
নিশীঃ তনয়া তোর সাথে জড়িত কোন কিছুই আমি আয়াতের জীবনে থাকতে দিবো না।
আয়াত অফিসে গিয়ে কাজে মন দিতে পারছে না। কারন বার বার #বই গল্পটার কথা মাথায় ঘুরতে থাকলো। তাই দুপুরেই বাড়ি চলে আসলো। বাড়ি গিয়ে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজেও বইটা পেলো না। নিশীর কাছে জিগেস করায় নিশী এমন ভাব করছে যেনো ও বইটার বিষয়ে কিছু জানে না। কিন্তু আয়াত যেভাবে বইটা খুজছিলো তা দেখে ওর খুব ভয় করতে ছিলো। যদি আয়াত বুঝতে পারে বইটা ও পুড়িয়ে ফেলছে তাহলে কি হবে সেটা ভেবে! আয়াত বইটা না পেয়ে ভাবছিলো তাহলে রাত থেকে যা পড়ছি সব কি আমার মনের ভুল? না না এমন ভুল আমার হতে পারে না। আচ্ছা বইটা কি বর্তমানে লাইব্রেরিতে পাবো? খোজ নিয়ে দেখি! আবার পরোক্ষনেই ভাবলো বইটার জন্য আমার মনটা এতটা ছটফট কেন করছে? এর আগেও তো কত বই পড়ছি, কত গল্প পড়ছি এর থেকে হাজার গুন ভালো বইও পড়ছি , কত গল্প পড়েও অসমাপ্ত রাখছি কেই সে গল্পের পরেরটা জানার জন্য মনটাতো এতটা আনচান করেনি? তাহলে এখন কেন করছে? কি আছে বইটার মাঝে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আয়াত বাড়ি থেকে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
বেশ বড়ো একটা লাইব্রেরিতে গিয়ে বইটার নাম আর লেখকের নাম বললো । লাইব্রেরির লোকটা বইটার নাম শুনে বললো
——-অনেক দিন পর বইটার খোজ কেউ করলো! কিন্তু বছর খানেক আগে বইটা প্রচুর পরিমানে বিক্রি হয়েছে। লেখিকা তার প্রথম বইয়ে অনেক সাফল্য পেয়েছে।
আয়াতঃ রিয়েলি! তাহলে ঐ লেখিকার আরো বই থাকলে দিন তো?
——-আরে সেটা কি করে সম্ভব! লেখিকার তো আর কোন বই বের হয়নি!
আয়াতঃ কেন?
——-আরে আপনি বোধয় জানেন না! বইটা বের হবার মাস কয়েক পর মানে প্রায় বছর খানিক আগে লেখিকার মৃত্যু হয়।
আয়াতঃ কি?
——–হ্যা স্যার। খুব কম বয়সে লেখিকা মারা যায়।
আয়াতঃ আপনি এত কিছু কি করে জানেন?
——আসলে লেখিকা আমাদের এলাকার মেয়ে ছিলো।
আয়াত আর কোন কথা না বলে বইটার টাকা দিয়ে বইটা নিয়ে সোজা পার্কে চলে গেলো। কারন বাড়ি পড়তে বসলে বাড়ির সবাই বার বার বিরক্ত করে। আয়াত যে পর্যন্ত পড়েছিলো সে পৃষ্ঠাটা খুলে পড়া শুরু করে——–
—–চলে গেলো আয়াত!
আর আমি এয়াপোর্টের ভিতরের চেয়ারে বসে কান্না করছি। আয়াতের গিফ্টটা হাতে নিলাম। উপরের র্যাপিং পেপারটা খুলে দেখলাম ভিতরে একটা বই। সেই বইটা যেটার মাধ্যমে প্রথম বার আমাদের পরিচয় হয়েছিলো। বইটার উপরে লেখা
তোমার জন্য তনয়া
তনয়া বইটা হাত বুলাতে বুলাতে আরো অঝোরে কাঁদছে। বইটা খুলতেই ভিতরে একটা চিরকুট পেলো সেটাতে লেখা—-
তনয়া,
তুমি জানো তুমি একটা পাগলী! তুমি বিভিন্ন ভাবে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করো আমাকে ভালোবোসো। কোন কিছু না বলে জড়িয়ে ধরো। আচ্ছা যখন তুমি আমায় জড়িয়ে ধরেছিলে তখন কি তুমি আমার হৃদয়ের আওয়াজ শুনতে পাওনি? যেখানে শুধু তোমার নাম লেখা। বিভিন্ন ভাবে বুঝাতে চেষ্টা করো তুমি আমায় ভালোবাসো। একবারও কি বোঝার চেষ্টা করোনি আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি!
সেই প্রথম দেখা থেকে তোমায় ভালোবাসি। তুমি যদি রোজ লুকিয়ে ১০ বার আমায় দেখতে আমি ৩০ বার দেখতাম তা কি তুমি জানো? তোমার চোখ, গলার তিল, ঠোঁটের বাঁকানো হাসি, রহস্যময়ী চোখ মারা। তুমি জানো তোমার গলার জোড়া তিলদুটো আমার ভিষন ভালো লাগে। তুমি হাসি দিলে হাসিটা বাঁকানো হয়, কিন্তু তোমার বাঁকানো হাসি দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। তোমার গুনগুনিয়ে গান গাওয়া, পড়তে বসলে কলম মুখে নেয়া তোমার প্রতিটা জিনিস আমি খেয়াল করেছি। তাহলে তুমি ভাবলে কি করে তোমাকে ভালোবাসি না?
আরে পাগলী সবসময় আমায় ভালোবাসো না বুঝিয়ে আমার ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারলে না! তনয়া আমি ছোট বেলা থেকেই লাজুক আর চাপা স্বভাবের ছেলে যার কারনে শতবার চেয়েও তোমায় নিজের মনের কথাটা বলতে পারি নি। ভেবেছিলাম তুমি বুঝে নিবে। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম তুমিতো বাঙালি মেয়ে। যাদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফোটে না। যাই হোক সব কথার এক কথা যেটা তোমায় লিখে নয় নিজের মুখে বলতে চাই। শুনবে?
ইতি——-
আয়াত
চিঠিটা পড়ে তনয়া যেনো পাগলের মত হয়ে গেলো। কেন ও গিফ্টটা আয়াতের কথা মত আগে খুলে দেখলো না সেটা ভেবে নিজের কপাল নিজে চাপরাচ্ছে। হঠাৎ এয়ারপোর্টের এনাউসমেন্ট মাইকে আয়াত বলছে
আয়াতঃ অনেক কেঁদেছেন ম্যাডাম! আর কান্না করবেন না। নয়তো আপনার মাথা ব্যাথা করবে! তখন কিন্তু আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারবো না।
তনয়া চারদিকে আয়াতকে খুজতে লাগলো। দেখে দূরে দাড়িয়ে আছে। আয়াতকে দেখা মাত্র তনয়া ঝড়ের বেগে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আয়াতও তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো
আয়াতঃ তনয়া বিয়ে করবে আমায়?
তনয়াঃ (হা হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো) ভালোবাসি না বলেই সোজা বিয়ের প্রস্তাব?
আয়াতঃ খুব বেশি ভালোবাসি বলেই তো তোমার থেকে আর দূরে থাকা সম্ভব নয়। আমরা আজই বিয়ে করবো।
তনয়াঃ কি? আজ? (চোখ বড় বড় করে)
আয়াতঃ হুমমম আজই।
তনয়াঃ কিন্তু আয়াত আমাদের পরিবার?
আয়াতঃ বাংলাদেশের প্লেন ল্যান্ড হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা এখানে এসে পড়বে?
তনয়াঃ কি? তাহলে তুমি?
আয়াতঃ ম্যাডাম আমি এখান থেকে চলে যেতে নয় বরং আপনার আর আমার পরিবারকে রিসিভ করতে আসছি। আমার বাবা মাকে কয়েকদিন আগে তোমাদের বাসায় পাঠিয়েছি। তাদের সব খুলে বলায় তারাও রাজি হয়ে গেলো আর তাদের অনুরোধ করলাম তোমাকে কিছু না জানাতে। আমি ভেবেছিলাম আমি চলে যাবার কথা শুনলে হয়তো তুমি তোমার মনের কথা বলবে কিন্তু তা তো হলো না। তাই নিজে থেকেই তোমায় সব বললাম। সারপ্রাইজ কেমন লাগলো ম্যাডাম?
তনয়াঃ খুব বাজে!
আয়াতঃ রিয়েলি!
তনয়াঃ হুমমমম। আয়াত!
আয়াতঃ হুমমম বলো?
তনয়াঃ এবার তো কোমরটা ছাড়ো! অনেক্ষন ধরে জড়িয়ে ধরে আছো। দেখো সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে?
আয়াতঃ জ্বি না ছাড়বো না। আর এটা বাংলাদেশ না। এখানে এসব কেউ মাইন্ড করে না।
তনয়াঃ আচ্ছা!
আয়াতঃ হুমমম। ম্যাডাম বিয়ের সব আয়োজন হয়ে গেছে। এখন শুধু কবুল বলে আপনাকে বাসর ঘরে তোলা বাকি! আজ দুবছর জ্বালানোর সব শোধ আজ তুলবো মনে রেখো!
তনয়াঃ হু আর ইউ?
আয়াতঃ এ্যাঁ
তনয়াঃ আমার আয়াত কোথায়? আপনি কে?
আয়াতঃ কি বলছো?
তনয়াঃ যে আয়াত আমাকে সামান্য ভালোবাসি কথাটা বলতে দু বছর লাগিয়ে দিলো সে মাত্র দশ মিনিটে বাসর ঘর পর্যন্ত পৌছে গেছে। কে আপনি? আমার আয়াত কোথায়!
আয়াতঃ তোমার আয়াত হারিয়ে গেছে।
তনয়াঃ কোথায়?
আয়াতঃ তনয়ার হৃদয় গহীনে।
তনয়াঃ আমি তাকে ফেরত চাই।
আয়তঃ নিজের হৃদয় থেকে খুজে নাও।
তনয়াঃ কিভাবে?
আয়াতঃ (তনয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে) আই লাভ ইউ। এভাবে!
তনয়ার হৃদস্পন্দন যেনো বেড়ে গেলো। তিনটা শব্দে মিলিত হয় একটা ছোট বাক্য অথচ তার গভীরতা হৃয়দটাকে আড়পাড় করে দেয়।
তনয়াঃ আয়াতকে জড়িয়ে ধরে আই লাভ ইউ টু । অনেক্ষন এভাবে জড়িয়ে ধরে ছিলো।
কিছুক্ষন পর ওদের পরিবারের সবাই এলো। প্রায় অনেক দিন পর নিজের বাবা মাকে দেখে তনয়ার খুব ভালো লাগতে ছিলো। সবাই মিলে আয়াতদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। বাড়ির গিয়ে তনয়া চোখ ছানাবড়া আয়াত অনেক সুন্দর করে সব সাজিয়েছে। মনে হয় বিয়ের প্ল্যান অনেক দিন আগে থেকে। তনয়া আয়াতকে টেনে এক কোনায় নিয়ে বললো
তনয়াঃ মিঃ আয়াত আজ যদি আমি আপনাকে না বলতাম তাহলে এসব সাজ সজ্জার কি হতো?
আয়াতঃ নো চান্স ম্যাডাম! আমি আপনার মত বোকা না । আপনার চোখের ভাষা আমি অনেক দিন আগেই পড়ে নিয়েছি। তাই জানতাম উত্তর হ্যা ই হবে। তাই আগে থেকেই বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।
তনয়াঃ এত কনফিডেন্ট নিজের উপর।
আয়াতঃ (তনয়ার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে )। নিজের উপর না আমাদের ভালোবাসার উপর।
তনয়াঃ জানি না কোন পুণ্যের ভাগ্যে তোমায় পেলাম!
আমি অনেক খুশি ছিলাম আজ আয়াতকে সবসময়ের জন্য নিজের করে পাবো বলে। কিন্তু মনের ভিতর একটা ভয় আমাকে বাঘের মত তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
চলবে————