© অদৃশ্য ভালোবাসা অনুভূতি– পর্বঃ-২
লেখাঃ শারমিন আক্তার ( সাথী )
-বইয়ের লেখিকার নামটা দেখে আয়াতের হৃদয়টা কেমন যেনো করে উঠলো। নামটা বেশ পরিচিতো মনে হলো।
কিন্তু আয়াত ভাবছে আমার নাম মোঃ আয়াত হাসান আর লেখিকার নাম মিসেসঃ তনয়া আয়াত হাসান। তাহলে কি লেখিকার বরের নামও আয়াত হাসান? নাকি অন্য কিছু? মাথায় আসছে না। দূর এত কিছু না ভেবে বইটা পড়া শুরু করি। বইটার প্রথম পেজ এ দেয়া,
মহান আল্লাহ তা’আলার নামে শুরু করলাম।
উৎসর্গ
আমার ওনি।
যে কিনা শুধু আমার বেঁচে থাকারই না আমার লেখারও অনুপ্রেরণা।
পরের পৃষ্ঠায় লেখা—
এটা কোন কাল্পনিক জীবনী না বরং বাস্তব জীবনী।
তারপর আরো কিছু লেখার পর গল্পটির শুরু হলো। আয়াত বইটি পড়া শুরু করলো।
আজ লাইব্রেরিতে প্রথমবার ওকে দেখলাম। আমি তনয়া। লাইব্রেরিতে বই নিতে গিয়ে আমি আর ও একই বইতে হাত দিলাম। বইটির নাম #রাগ_অনুরাগ। লেখক আমার প্রিয় কাশেম বিন আবুবাকার। দুজনেই একই বইতে হাত দেয়ায় দুজনেই কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। তখন ওর নাম জানতাম না। পরে জেনেছিলাম ওর নাম আয়াত।
আয়াতঃ আপনি কি এই বইটিই পড়বেন?
তনয়াঃ জ্বি হ্যা। কেন?
আয়াতঃ আসলে আমিও এটাই পড়তে চাইছিলাম। গত কাল কিছুটা পড়ে রেখে গেছিলাম। আজ বাকিটা পড়তে চাইছিলাম।
তনয়াঃ আমারো সেইম কেস!
আয়াতঃ ওহ ঠিকআছে তাহলে আপনি পড়ুন আমি পড়ে পড়বো কেমন!
তনয়াঃ আরে না না আপনি পড়ে নিন। আর তাছাড়া আমি অন্য একটা বই পড়বো।
আয়াতঃ আপনি কত পেজ পর্যন্ত পড়ছেন?
তনয়াঃ ৫৮!
আয়াতঃ রিয়েলি! আজব!
তনয়াঃ মানে?
আয়াতঃ আমিও একই পেজ পর্যন্তই পড়েছি। তো আপনার অসুবিধা না থাকলে এক সাথে বসে বইটা পড়তে পাড়ি।
তনয়াঃ উমমমম। ওকে। কিন্তু তার আগে পরিচয়তো জেনে নি? আমি তনয়া আপনি?
আয়াতঃ আমি আয়াত! নাইস টু মিট ইউ তনয়া।
তনয়াঃ সেই টু ইউ।
দুজন একসাথে পাশাপাশি চেয়ারে বসে বইটা পড়তে ছিলাম। কিন্তু পড়ার থেকে বেশি একে অপরকে দেখছিলাম। বিশেষ করে আমি! আমি বারবার আয়াতের দিকে দেখতেছিলাম। এ জন্য না যে, আয়াত অনেক সুন্দর! হ্যা সত্যিই আয়াত অনেক সুন্দর কিন্তু আমি আয়াতের সৌন্দর্য্য না ওর ঠোঁটের উপরের তিলটা বারবার দেখছিলাম। ছেলেদের ঠোঁটের উপরের তিল যে এত আকর্ষনীয় আর মন মোহীত হতে পারে আমার জানা ছিলো না। আর আয়াতের চুল গুলো অসম্ভব সুন্দর ছিলো। এক কথায় আয়াতকে প্রথম দেখে আমি ক্রাসিত। কিন্তু পছন্দ আর ভালোবাসা অনেক দূরের ব্যাপার। বাদ দেই ওসব কথা বইটা পড়া শেষে দুজনেই চলে আসলাম। আয়াতের মত রসকষহীন ছেলে আমি আমার জীবনে দেখিনি। একটা সুন্দরী মেয়ে পাশে বসে ছিলো অথচ এককাপ কফির কথা জিগেস করাতো দূরে থাক ঠিকমত কথাও বললো না। ব্যাটা কিপটে কোথাকার! সিডনীর মত জায়গায় থেকেও টোটাল টিপিক্যাল ব্যাগডেটেট বাঙালি ছেলেদের মত ব্যাবহার। ও হ্যা বলাই হয়নি আমি লেখাপড়ার জন্য সিডনীতে থাকি।
আয়াতের সাথে পড়ের বার দেখা হলো এ বন্ধুর পার্টিতে। স্যাম তার বার্থডে উপলক্ষে বড় করে পার্টি দেয় সেখানে আমিও গেছিলাম। স্যাম আমার ক্লাসমেট। আর আয়াত স্যাম এর বড় ভাইয়ের বন্ধু। সে হিসাবে ও পার্টিতে গেছিলো। সেখানে আমার বেশির ভাগ ফ্রেন্ডই সিডনীর ছিলো। বাঙালি ফ্রেন্ড খুব কম ছিলো। সেখানে আয়াতকে দেখে টুকটাক কথা বললাম। আমি সেখানে শাড়ি পড়ে গেছিলাম।
পার্টি শেষে আমি আর আয়াত একসাথেই বের হলাম। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় কোন গাড়ি বা ক্যাব পাচ্ছিলাম না। তা দুজন ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলাম। কারন বাড়ি বেশি দূরে না। হাটা পথ চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিটের মত। নির্জন রাস্তায় দুজন মানবী নীরব হয়ে হাঁটছে! কারো মুখে যেনো কোন কথা নেই। মনের মধ্যে হাজারো কথা সাজাচ্ছে কিন্তু কেন যেনো কথাগুলো পেট থেকে মুখ পর্যন্ত আসছে না। তনয়া বার বার করে চাইছে আয়াত কিছু বলুক কিন্তু আয়াত সে তো মুখে গ্লু লাগিয়ে চুপ করে আছে। নীরবতা ভেঙে তনয়াই বললো
তনয়াঃ আচ্ছা আপনি কি এখন আর লাইব্রেরিতে যান না?
আয়াতঃ হুমমম যাই তো প্রায়ই। কেন?
তনয়াঃ না সেদিনের পর আপনাকে আর দেখিনি তাই।
আয়াতঃ আসলে সেদিনের সে সময়ে তেমন যাওয়া হয় না। শেষ বিকালের দিকে বেশি যাই।
তনয়াঃ ওহ। আচ্ছা আপনি এখানে কি করেন? মানে পড়াশুনা নাকি চাকরি?
আয়াতঃ পড়াশুনা করি বাট আমার বাবার এখানে ব্যাবসায় আছে তাও টুকিটাকি দেখাশুনা করি। আমার কোর্স কমপ্লিট হতে আরো দু বছর লাগবে। আপনি?
তনয়াঃ পড়াশুনা করি। এখানে একটা ফ্রেন্ডএর সাথে থাকি। আমার কোর্স শেষ হতে এখনো প্রায় চার বছর লাগবে।
আয়াতঃ ওহ। তারপর আবার দুজন নীরব হাটতে থাকে। কিছুক্ষন পর তনয়া তার গন্তব্যে পৌছে যায় আয়াতের পৌছাতে এখনো সময় লাগবে। তনয়া বাড়ির ভিতর ডুকতে ডুকতে বললো
তনয়াঃ বাই আয়াত।
আয়াতঃ তনয়া শুনুন?
তনয়াঃ হ্যা বলুন?
আয়াতঃ আপনাকে শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে।
তনয়াঃ মৃদু হেসে। ধন্যবাদ।
আয়াতঃ বাই টেইক কেয়ার।
তনয়াঃ ইউ টু।
তারপর প্রায়ই আয়াতের সাথে দেখা হতো। কখনো লাইব্রেরিতে ,কখনো কলেজে, কখনো কফিশপে। ততদিনে নিজেদের ভিতর সম্বোধনটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে গছে। কিন্তু দুজন শুধু বন্ধুর মতো ছিলাম। আমি আয়াতকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ওর সব কিছুর প্রতি পাগলের মত হয়ে পড়েছিলাম। ওর নেশায় পড়ে গেছিলাম। বিভিন্নভাবে বুঝাতে চাইতাম যে আমি আয়াতকে ভালোবাসি। কিন্তু আয়াত কেন যেনো বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকতো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের পটায়। কিন্তু আমি মেয়ে হয়ে ছেলেকে পটানোর চেষ্টা করছিলাম। বিভিন্নভাবে ওকে নিজের দিকে টানতে চাইতাম। কিন্তু ঐ যে বললাম রসকষহীন মানুষ, যে কিনা একটা মেয়ের মনের কথা বুঝতে পারে না।
একদিন কেন যেনো আয়াতকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হলো। কেন যেনো ওর বুকে মাথা রাখতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু ওকে জড়িয়ে ধরার অধিকারতো আমার নাই। ও সেটা দেইনি তখনো। কলেজে গিয়ে দেখি ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আমি ডাক দিলাম। তারপর আমার কাছে এসে বললো
আয়াতঃ হ্যা বলো তনয়া!
আমি ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কেনো যেনো নিজেকে আটকাতে পারছিলাম না। আয়াত অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলো। কারন ও চিন্তাও করতে পারেনি আমি এভাবে আয়াতকে জড়িয়ে ধরবো। বেশ কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে ছিলাম। তারপর নিজে থেকে ছেড়ে দিয়ে কোন কথা না বলে চলে এলাম। আয়াত বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর কয়েকদিন আমি আয়াতের সামনে যাইনি! তারপর আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আয়াতও আমাকে আর জড়িয়ে ধরার বিষয়ে কোন প্রশ্ন করেনি। দেখতে দেখতে আয়াতের কোর্স শেষ হয়ে গেলো। আমাদের সম্পর্কের কোন উন্নতি হয়নি। বন্ধুর মতই ছিলাম আমরা।
কয়েকদিন পর আয়াত দেশে চলে যাবে। ভাবতেই মনটা কেঁদে উঠছে। তাহলে কি আয়াত সত্যিই আমাকে ভালোবাসে না। যদি বাসতো তবে এই দু বছরে একদিনও কি বলতো না! একবারও কি বোঝানোর চেষ্টা করতো না! আমি না হয় মেয়ে তাই নিজের অনুভুতিগুলো চেপে রেখেছি কিন্তু ও তো ছেলে ও কেন নিজের আবেগ অনুভুতি চেপে রাখতে যাবে? তাহলে নিশ্চই আমার প্রতি ওর কোন অনুভুতি নেই। কথা গুলো ভাবতেই নিজের অজান্তে চোখ থেকে জল পড়তে লাগলো।
আজ আয়াত দেশে চলে যাবে!
আমি কি ওকে নিজের মনের কথা বলবো? না থাক যার মনে আমার জন্য জায়গা নাই শুধু শুধু জোড় করে জায়গা বানাতে যাবার কি দরকার?
আয়াতকে এয়ারপোর্ট ড্রপ করতে আসলাম। যাবার আগে কিছুক্ষন দুজন চুপ করে বসে ছিলাম। এই প্রথম আয়াত নিজে থেকে নিজের নীরবতা ভাঙলো
আয়াতঃ তো নেক্সট প্ল্যান কি?
তনয়াঃ জানি না! (খুব আস্তে করে)
আয়াতঃ যাই এয়ারের টাইম হয়ে গেলো। আমি যাই। ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখোঅ আর এটা তোমার জন্য।( একটা র্যাপিং পেপারে মোড়া কিছু একটা গিফ্ট)। আর বললো এখনই খুলে দেখো নয়তো হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। এটা বলে আয়াত হাটা ধরলো। আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে ওর যাবার পানে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর প্লেন চলে গেলো। চলে গেলো আয়াত। আমি তখনও এয়ার পোর্টের ভিতর চেয়ারে বসে কাঁদছি। তারপর গিফ্টটা খুলতে নিলাম।
আয়াত! আয়াত! আয়াত!
হঠাৎ নিশীর ডাকে আয়াতের হাত থেকে বইটা পড়ে গেলো।
নিশীঃ আয়াত রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে? এখনো স্টাডি রুমে তুমি বই পড়ছো? চলো ঘুমাবে !
আয়াত নিচ থেকে বইটা তুলে আবার বইটার জায়গা মত রেখে দিলো।
তারপর নিশীর সাথে যেতে নিলো। কিন্তু একি মনে হচ্ছে আয়াতের হাত কেউ ধরে রাখছে। মনে হয় সে চাইছে আয়াত এখানে আরো থাকুক। আয়াত যেতে চেয়েও যেতে পারছে না।
নিশীঃ কি হলো আয়াত? এখনো দাড়িয়ে আছো? চলো বলছি?
আয়াতঃ কিছু না তুমি যাও আমি আরো কিছুক্ষন এখানে থাকবো।
নিশীঃ আয়াত বেশি পাগলামো ভালো না। চলো বলছি বলে আয়াতের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলে নিশী ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়। মনে হয় কেউ নিশীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছে। কিন্তু আয়াত তো ধাক্কা দেয়নি? তাহলে কে?
চলবে————-
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।