অজানা কারণ

অজানা কারণ !! Part- 05

আমার বিশ্বাস জয়ার খুন আর ভাইয়ের খুন দুটোই মিনহাজ করেছে। কিন্তু মিনহাজ কেন এসব করেছে?
ওই মেয়ের সাথে উনার কি শত্রুতা সেটা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু আমার ভাই?
আমাকে যদি উনি বিয়ে না করতেন, তাহলে আমার ভাইকে উনার চেনার প্রশ্নই আসতো না। তবে কিসের এত রাগ আমার ভাইয়ের প্রতি?

বিয়ের শুরু থেকে অন্যায় করে আসছেন আমার সাথে। বিয়ের পরেও বাদ যায়নি। আর এরপর আমার ভাই কেও ছাড়লেন না। তবে কি আমার পরিবারের সাথেই উনার শত্রুতা? না। যদি শুধু আমার পরিবারের সাথেই হতো তাহলে জয়ার খুন কেন হল? সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন কিছু মেলাতে পারছি না।

এসব কিছু পরেও মেলানো যাবে। এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মায়ের পাশে থাকা। তাই আমি আর কোন দেরি না করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
আমাদের বাসার সামনে মানুষের প্রচুর ভিড়। এত ভিড় কেন আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। অল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টা এতো দূর বিস্তর কি করে হতে পারে?

ভিড় ঠেলে আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভাইয়ের মুখ সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। পাশেই মা টেবিল এর সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। মায়ের মুখটা যেন কেমন মলিন দেখা যাচ্ছে। একেবারে নীল হয়ে গেছে।
আমি ভাইয়ের মুখের উপর থেকে সাদা কাপড় টা একটু সরিয়ে দিলাম। খুবই খারাপ ভাবে হত্যা করা হয়েছে ভাইকে।দুই দিনের ভিতর এত কিছু সহ্য করে ফেলেছি যে, আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল ও আসছে না।

আমি ধীরে পদে মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। সান্ত্বনা স্বরূপ মায়ের কাঁধে হাত দেওয়ার সাথে সাথে মা মেঝেতে পরে গেল। মাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে আমি চমকে উঠলাম! মাকে পাগলের মত ডাকতে থাকলাম ,কিন্তু মার কোনো সাড়াই নেই।

এরপর কখন কি হয়েছে আমার আর কিছুই জানা নেই। কখন যে জ্ঞান হারিয়েছে সেটাও জানি না। সম্ভবত দুদিন পরে আমার জ্ঞান ফিরেছিল।জ্ঞান ফেরার পর আমি নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। আমার ঠিক ডান পাশেই চেয়ারে বসে আছে মিনহাজ। মিনহাজের হাতে একটা কালো রঙের ডায়েরি রয়েছে।
মিনহাজ কে ডায়েরী হাতে বসে থাকতে দেখে আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম।

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিনহাজ আগ বাড়িয়ে বলল,
_তুমি ঠিক আছো? তোমার শরীরটা ভীষণ খারাপ!
তবে আশা করছি এখন তুমি ঠিক আছো।

আমি কিছুই বললাম না। আগের মতই তাকিয়ে থাকলাম। পুরো ঘরটা একবার দৃষ্টি বুলালাম। আরো দুজন মহিলা ডাক্তার রয়েছে। সম্ভবত গাইনি বিভাগের হবে। সবাইকে একবার একবার দেখে আমি আবারও মিনহাজের দিকে তাকালাম।

কেমন যেন মিনহাজের প্রতি আমার প্রচুর ঘৃণা! ওর দিকে তাকানো মাত্রই আমার মনে পড়ে গেল পিছনের সব ঘটনা। মিনহাজ একজন খুনি। আমি কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই মিনহাজ বলে উঠলো,

_আচ্ছা নীলা তোমার কি হয়েছে বলোতো? তুমি এসব কি আজেবাজে কথা লিখেছ ডাইরিতে? কবে আমি তোমায় ৬ জন বন্ধুকে নিয়ে অত্যাচার করেছিলাম? আর আমাদের বাসর রাতে,,,,,ছি এসব কেমন কথা!
লোকে পড়লে কি বলবে? আমি তো বুঝতেই পারছিনা তুমি এ সব কেন লিখেছ? যা ঘটেনি সেটাও। আর যা ঘটেছে সেটাও।

হ্যাঁ এটা সত্য তোমার ভাই খুন হয়েছিল। আর তোমার মা সেই দুঃখে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু এসব কিছুর সাথে তুমি আমাকে কেন যুক্ত করেছো? আর জয়া।
কে এই মেয়ে? আমিতো এই নামে কাউকে চিনিই না।
তাহলে তুমি ওই মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কি করে জুড়ে দিলে? সত্যি তোমার যে কি হয়েছে সেটা তুমিই জানো!

আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার মুখে তালা আটকে দিয়েছে। আমি কিছুই বলতে পারছি না। সবকিছু আগের থেকেও বেশি এলোমেলো লাগছে। আমাকে চিন্তার জগতে ব্যস্ত দেখে, মিনহাজ চেয়ার আর আরো কাছে এনে বসল। এক হাত আমার মাথার উপর রেখে, আরেক হাত দিয়ে আমার হাত শক্ত করে ধরে বলল,

_দেখো নীলা! আমি জানিনা তোমার কি হয়েছে। বা হঠাৎ তুমি কেন এমন করছো। দয়া করে এসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো! অন্তত আমাদের সন্তানের জন্য!

মিনহাজের এ কথায় আমি প্রচন্ড রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। কথা বলার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কথা বলতে পারলাম না। আমাকে এভাবে ছটফট করতে দেখে মিনহাজ দুজন মহিলা ডাক্তার কে উদ্দেশ্য করে বলল,

_ওর হয়তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! আর ও মানসিকভাবে একেবারেই ভারসাম্যহীন। সেটা আপনারা এই ডায়েরী পড়লেই বুঝতে পারবেন। না হলেও যা লিখেছে এটা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। দয়া করে ওর দিকে পরিপূর্ণ খেয়াল রাখবেন!

মিনহাজ আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। হয়তো আরো পেশেন্ট আছে সেজন্যেই।
আমি মোট ১০ দিন হসপিটালে ছিলাম। এই দশদিন মিনহাজ আমার প্রতি প্রচুর খেয়াল রেখেছে।যেটা আমার জন্য ছিল একেবারে অবিশ্বাস্যকর!

বেশ কিছুদিন হসপিটালে থাকার পর রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম। বাড়ি আসার ঘন্টাখানেক পরেই পুলিশ বাড়ির ভেতরে হানা দিল। পুলিশ দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমাকে ঘরের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে মিনহাজ পুলিশের সাথে কথা বলতে লাগলো,

_দেখুন স্যার! আমার স্ত্রী এখন খুব অসুস্থ। আপনারা দয়া করে এই কেস নিয়ে পরে কথা বলুন। এমনিতেই ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। এই মুহূর্তে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করা ঠিক হবে না। দয়া করে আপনারা চলে যান!

মিনহাজ যখন পুলিশকে অনুনয়-বিনয় করতে ব্যস্ত। ঠিক তখন দুজন পুলিশ জয়ার লাশ এনে মিনহাজের সামনে রাখলো। জয়ার লাশ দেখে মিনহাজ চমকে উঠল!

মিনহাজ কে এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুলিশ অফিসার বলে উঠলো,
_কি ব্যাপার মিস্টার মিনহাজ!
আপনি এ ভাবে চুপ করে আছেন এখন? এই লাশটা আপনার বাড়ির ম্যানহোলের ভেতরে পাওয়া গেছে।
শুধু তাই না যে ছুরি দিয়ে একে হত্যা করা হয়েছে,সে ছুরিটা ও আপনার বাড়িতে পাওয়া গেছে।

আর যে ছুরি দিয়ে রাজার খুন হয়েছে সেই , ছুরিটাও আপনার বাড়িতে পাওয়া গেছে।আর আপনার স্ত্রীর মাকে যে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষের কৌটাও এই বাড়িতে পাওয়া গেছে।

মিনহাজ তোতলাতে তোতলাতে বললো,
_কী বলছেন এসব? নীলার মাকে কেউ বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে? কিন্তু এসবকিছু আমার বাড়িতে কিভাবে আসলো? আমিতো কোন কিছু বুঝতে পারছিনা।

পুলিশে মিনহাজের কাঁধে হাত রেখে বলল,
_আমি বুঝতে পারছি আপনি খুব চিন্তিত। তবে যেহেতু আপনি না করছেন আপনার স্ত্রীকে এই মুহুর্তে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি।
কিন্তু দুদিন পর যখন এসব কিছুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্টস বের হবে আমরা আবার আসব।
ততদিন আপনি দয়া করে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে এখানেই অবস্থান করবেন! আমাদের না বলে শহরের বাহিরে যাবেন না।

পুলিশ মিনহাজের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আমি ধীরে ধীরে লিভিং রুমে এগিয়ে আসলাম। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে মিনহাজ বলল,
_তোমাকে না বললাম শুয়ে রেস্ট করো। উঠে এসেছ কেন তাহলে? যাও রুমে গিয়ে শুয়ে থাকো।

আমি মিনহাজের পাশে বসতে বসতে বললাম,
_আমি সব শুনেছি। পুলিশ আমাদের বাড়ি ম্যানহোল থেকে একটা লাশ উদ্ধার করেছে। আর সেটা জয়ার লাশ। আমি জয়াকে দেখেছি নিজ চোখে। আর সেটাও জীবিত অবস্থায়। আমার চোখের সামনে ও আপনার সাথে এই রুমে ঢুকেছিল। কিন্তু এরপর মৃত অবস্থায় বের হয়েছিল।

আর আমার ভাই ,মা সবাই খুন হয়ে গেল? কেন হচ্ছে এসব? আপনি আমাকে হসপিটালে বলেছেন এসব কিছুই ঘটেনি। শুধু ভাই হত্যা হয়েছে। আর মায়ের মৃত্যুটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি তো দেখছি সব সত্যি।

মিনহাজ আমার পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
_তুমি চিন্তা করোনা! সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। তুমি একটু শান্ত হও! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমাদের সন্তানের কিছু হবে না!

আমি মিনহাজকে সরিয়ে দিয়ে উঠে চলে আসলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! এতকিছু কিভাবে সহ্য করা যায়?

দুদিন পর বাড়িতে আবারো পুলিশে এলো। পুলিশকে দেখে মিনহাজ আবারও ঘাবড়ে গেল। মিনহাজ কিছু বলার আগেই পুলিশ বলে উঠলো,

_দেখুন আজ আর আমাদের কোন অনুরোধ করবেন না! কারণ আমরা আজকে আপনার স্ত্রীকে নিজের মা, ভাই এবং জয়া নামের মেয়েটির খুনের দায়ে অ্যারেস্ট করতে এসেছি। সমস্ত প্রমান আপনার স্ত্রীর বিপক্ষে।সবগুলো এভিডেন্সের মাঝে আপনার স্ত্রীর ফিঙ্গারপ্রিন্টস পাওয়া গেছে। উনাকে ডেকে দিন!

মিনহাজ কিছু বলতে পারলো না। ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল। আমি হাঁটতে হাঁটতে লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে আসলাম। মিনহাজ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

_নীলা তুমি খুন করেছো?

ডাইরির এতোটুকু অংশ পড়ে মানহা ডাইরিটা জোরে বন্ধ করে দিল। চিৎকার করে উঠল মানহা। মানহার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে এলো।

ঘরের সব কিছু এলোমেলো করে, ভাঙচুর করতে করতে মানহা বলল,
_সবাই আমাকে ঠকাচ্ছে। আর মিনহাজও।
সবাই কেন ঠকাচ্ছে আমাকে?

একটা মেয়ে এগিয়ে এসে উত্তেজিত মানহা কে শক্ত করে ধরে বললো,
_ম্যাডাম আপনি শান্ত হয়!
স্যার ৬ বছর পরে দেশে ফিরছেন। আপনার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল। আপনি এত রেগে আছেন কেন?

মানহা শরীরের সব শক্তি দিয়ে মেয়েটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলল,
_তোর স্যার আসার ধারধারিনা আমি। ও আমাকে ঠকিয়েছে। মিথ্যে বলেছে আমার সাথে। ওকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না। খুন করে ফেলবো আমি!

মানহা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পরেই মিনহাজ ঘরে ঢুকলো। ঘরের এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে বলল,

_কি ব্যাপার জেরিন? ঘরের এ অবস্থা কেন কি হয়েছে? আর মানহা তোমার কি হয়েছে?
মিনহাজ এগিয়ে এসে মানহা কে উঠাতে নিলো।
কিন্তু মিনহাজের হাত এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে মানহা বলে উঠলো,

_খবরদার! আমাকে তুমি একদম টাচ করবে না। তুমি আমায় বোকা বানিয়েছে ।
দিনের পর দিন আমার সাথে মিথ্যে কথা বলেছো। তুমি আমাকে বলোনি নীলা তোমার স্ত্রী ছিল।

কেন বলোনি উত্তর দাও! মিনহাজ কোন কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলো। কোন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না!

মিনহাজকে চুপ থাকতে দেখে মানহা এগিয়ে আসলো। শার্টের কলার শক্ত করে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
_কথা বলছো না কেন? উত্তর দাও আমাকে।
আমি জানি নীলা কোন খুন করেনি। কেন ফাঁসিয়ে ছিলে তুমি ওকে?যাতে করে আরো হাজার মেয়ের জীবনটা নরক করতে পারো তাই? আসলে তুমি একটা চরিত্রহীন!

মিনহাজ আর কোন কিছু বলতে পারলো না। জোরে এক চড় মারল মানহাকে। মিনহাজের মা এগিয়ে এসে মানহা কে জড়িয়ে ধরে বলল,

_তুই এটা কি করলি মিনহাজ? ওর গায়ে হাত তুললি কেন?
মিনহাজ কোন কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মানহা এগিয়ে গিয়ে ডাইরিটা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল!

(চলুক,,,,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *